বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের অধীনে থাকা সড়কপথে ব্যক্তিগত যান ও গণপরিবহন চলাচলের সুযোগ দিয়ে টোল নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। নিজেদের বাস চলছে না, তাই অন্য পরিবহনের বৈধ চলাচলের সুযোগ করে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে টোল আদায়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিষয়টি পর্যালোচনায় এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। যদিও এই টোল আদায় বিআরটি কম্পানি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।
বিদ্যমান আইনে সড়ক ভাড়া দিয়ে টোল আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে বিআরটি প্রকল্প। বিআরটি হচ্ছে মূলত বাসের বিশেষায়িত পথ। বিআরটি কম্পানির বিজনেস মডেল অনুযায়ী এই পথে শুধু কম্পানির নির্দিষ্ট বাস চলার কথা ছিল, কিন্তু প্রকল্পটি ব্যর্থতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না। এরই মধ্যে প্রকল্পের সর্বশেষ মেয়াদ শেষ হয়েছে। নতুন করে মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে খরচও বাড়তে পারে।
বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি করিডরকে কেন্দ্র করে গুলিস্তান থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটিসির ১০টি বাস চলাচল করে।
বিআরটি কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টোল আদায় করা আদৌ বাস্তবসম্মত হবে কি না, সেটিও পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আমি সেই কমিটিতে নেই, তাই মতামত দেব না। কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এক লেনের সড়কে টোলের জন্য কি বুথ বসানো সম্ভব! এতে কি যান চলাচল স্বাভাবিক থাকবে?’
উল্টো পথে বিআরটির আশা
যানজট কমানোর আশা দেখিয়ে শুরু হয়েছিল বিআরটি প্রকল্প। চার বছরের কাজ এক যুগেও শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারবার মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ হয়নি বহুল আলোচিত-সমালোচিত বিআরটি। সম্প্রতি অসমাপ্ত প্রকল্পটিতে বিআরটিসির ১০টি বাস চলাচল করলেও এই পথে মূল বাস এখনো চালু করা যায়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, দিনে ১০ থেকে ১২টি বাস চলে, দুই প্রান্ত মিলিয়ে ১৬ থেকে ২০টি ট্রিপ হয়। পরিচালন ব্যয় মিটিয়ে কিছুটা লাভও হচ্ছে। যাত্রী বাড়লে বাস বাড়ানো যাবে। আর ভিন্ন অবকাঠামোর কারণে জটিলতা হচ্ছে না, সেটা মানিয়ে নেওয়া গেছে।
গত ১ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিআরটি করিডরে টোল আদায় করা যায় কি না, সেটা নিয়ে একটা সভা হয়। সেই সভায় প্রকল্প, সড়ক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সভা থেকে বিআরটি করিডরে টোল আদায়ের বিষয়ে একটি কমিটি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই কমিটি দেখবে এখানে টোল আদায় করা যায় কি না। গেলেও কী উপায় করা হবে, সেটা তারা দেখবে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিআরটি করিডরে টোল আদায়ের কোনো অবকাঠামো নেই। এখন টোল নিতে গেলে টোলের অবকাঠামো লাগবে। বিআরটি করিডরে টোল বসানোর জন্য জায়গা আছে কি না, এটার পরিচালন কিভাবে হবে? এটা তো প্রকল্পের মধ্যে ধরা নেই। সরকার যদি টোলের বিনিময়ে সড়ক ভাড়া দেয়, অন্যান্য পরিবহন চলার সুযোগ করে দেয়, তাহলে এটি বিআরটি বিজনেস মডেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।
বিআরটি করিডরে টোল কেন
বিআরটি প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে অধীন সড়কে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাস চালানো। কিন্তু এসব বাস না আসায় আপাতত বিআরটিসির বাস চলাচল করছে। এই পথে অন্যান্য অনেক গাড়িও চলছে, ফলে এখন যানজট তৈরি হচ্ছে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য টোল বসানোর চিন্তা করা হচ্ছে, যাতে সব গাড়ি এই করিডরে ঢুকতে না পারে। এই ধারণা থেকে টোল আদায় আলোচনায় এসেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিআরটি টোল আদায়ের কোনো প্রকল্প নয়। এই পথে অন্যান্য পরিবহন চালানো হলে সরকারের রাজস্ব আদায় হবে, কিন্তু প্রকল্পের মূল লক্ষ্য অর্জন হবে না। বিআরটি করিডরে নিজস্ব বাস চলবে, এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করা উচিত। টোল বসিয়ে রাজস্ব আদায় করলে প্রকল্পের মূলনীতি থেকে সরে আসা হবে।
টাকার সংকট, কাজ করছে না ঠিকাদার
প্রকল্পে এখনো অনেক সমস্যা রয়েছে। ঠিকাদারের অর্থায়নে সমস্যা রয়েছে, কাজের টাকা পাচ্ছে না। ফলে কাজ খুব একটা হচ্ছে না। এরই মধ্যে প্রায় ৯৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটি কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, কাজ খুব একটা হচ্ছে না। স্টেশনগুলোর অসমাপ্ত কাজ বাকি। ঠিকাদারের অনেক বিল দেওয়া বাকি। রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতি যেগুলো হয়েছে, সেগুলো মেরামত করার বিষয় আছে। প্রকল্পের ছোটখাটো কাজ এখনো আছে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সঙ্গে কিছু কিছু জায়গায় ব্যয় বাড়তে পারে।
বারবার বাড়ছে প্রকল্পের মেয়াদ
২০১২ সালের ২০ নভেম্বর একনেকসভায় অনুমোদন পায় ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট)’। তখন এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষ দিকে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে ২০২১ সালেও এই কাজ সমাপ্ত হয়নি। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। সে সময় বলা হয়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হবে।
সর্বশেষ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ২০২৩ সালের অক্টোবরে কাজ শেষ হবে, কিন্তু তা হয়নি। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু এই সময়েও কাজ শেষ করা যায়নি। ফলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০.৫ কিলোমিটার বিআরটি লেন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) অর্থায়ন করছে।