বিগত সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণে আসন্ন গরম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে বড় ঘাটতি থাকবে বলে প্রায় নিশ্চিত করেছেন বিদ্যুত্ খাত সংশ্লিষ্টরা। কেননা পর্যাপ্ত বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে জ্বালানি আমদানির জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দরকার তার সংস্থান নেই। শিগিগরই অর্থের জোগান দেওয়া যাবে বলেও পূর্বাভাস নেই। এমন বাস্তবতায় আসন্ন গরম মৌসুমে দৈনিক প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট পরিমাণ লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে বাড়বে জনভোগান্তি।
বিদ্যুত্ বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বেশি দামে বিদ্যুত্ কিনে কম দামে বিদ্যুত্ বিক্রি করায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার দেনায় ডুবেছে বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু দেশের বাজারে বিদ্যুত্-গ্যাস বিক্রি করে পিডিবির বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য টাকা এবং মার্কিন ডলার আগামী দুই বছরেও সংস্থান করা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রয়োজন সরকারের ভর্তুকি। গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় বিদ্যুতে ১ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি অনুমোদন করেছে। তবে সামগ্রিক প্রয়োজনের তুলনায় এ নগণ্য। ঐ কর্মকর্তা আরো বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বেসামাল বিদ্যুত্-জ্বালানি খাতকে সামাল দিতে পারছে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ খাতে রেখে যাওয়া গভীর ক্ষত স্বল্প মেয়াদে নিরাময় সম্ভব নয়। তাই আসন্ন গরম ও সেচ মৌসুমে লোডশেডিং তীব্র হওয়ার বিষয়টি প্রায় অবধারিত।
আগামী মার্চ থেকে দেশে গ্রীষ্মকাল ও সেচ মৌসুম শুরু হচ্ছে। ২ বা ৩ মার্চে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। গরম মৌসুমে দৈনিক প্রায় ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ চাহিদা দাঁড়াবে। কখনো কখনো তা ১৮ হাজার মেগাওয়াটও ছাড়িয়ে যাবে। জ্বালানি সংকটের কারণে বর্তমানে ১১ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুত্ সরবরাহ করতে পারছে। ফলে শীতের মধ্যেই গত কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দৈনিক এক থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের সংবাদ পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত যে প্রচেষ্টা তাতে আগামী গরমে দৈনিক গড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সরবরাহ করা সম্ভব হতে পারে। অর্থাত্ লোডশেডিং পরিস্থিতি তীব্রতর হবে।
এ প্রসঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুেকন্দ্র থাকলেও জ্বালানির সংস্থান নেই। তাই সমস্যা তৈরি হয়েছে। দেশীয় উত্স থেকে সরবরাহ বাড়ানোর শর্টকাট সমাধান নেই। তাই অনেকগুলো গ্যাসকূপ সংস্কার করে উত্পাদন কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত হবে না। এজন্য আমদানি বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ মার্কিন ডলারের সংস্থান নেই। তিনি বলেন, বিদ্যুত্-জ্বালানি সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। তাই সম্ভবপর সর্বোচ্চ ভর্তুকি দেওয়ার এবং ডলার সংস্থানের চেষ্টা করছে সরকার। এখন যত বেশি সম্ভব কয়লা ও এলএনজি আমদানি করে বিদ্যুেকন্দ্রগুলোতে উত্পাদন বৃদ্ধির চিন্তা করা হচ্ছে। এরপর পরিস্থিতি বুঝে জ্বালানি তেল আমদানি বাড়ানো হবে।
বিদ্যুত্ উপদেষ্টা আরো জানান, রমজানে সাহরি, ইফতার ও তারাবির সময় লোডশেডিং বন্ধ রাখা প্রথম অগ্রাধিকার। পিডিবি সূত্রে জানা যায়, আগামী মার্চ-এপ্রিলে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১৮ হাজার ২৩২ মেগাওয়াট। এই চাহিদা মেটাতে গ্যাসিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬,৪০০ মেগাওয়াট, কয়লা থেকে ৫,৫৫৮ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৪,১৪৯ মেগাওয়াট এবং ২,১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানি করা প্রয়োজন হতে পারে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুত্ উত্পাদন সক্ষমতা আছে ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে গত বছরের ৩০ এপ্রিলে। ঐ দিন ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট উত্পাদিত হয়। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট উত্পাদন করা হয়েছে গত বছর। বিদ্যুত্ বিক্রি করে প্রতি কিলোওয়াটে গড়ে প্রায় চার টাকার লোকসান করে পিডিবি। ঘাটতি পূরণে ভর্তুকি দেয় সরকার। অর্থসংকটে থাকায় বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। একই সঙ্গে চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় বিদেশি কোম্পানির বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পিডিবির দেনার পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুত্ কোম্পানিগুলোর পাওনা ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর বকেয়া বিলের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। বকেয়া পরিশোধে শেভরন, আদানিসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি দেশীয় বেসরকারি বিদ্যুত্ উত্পাদকদেরও চাপ রয়েছে। এ দেনা যতটুকু পরিশোধ করা সম্ভব হবে বিদ্যুত্ উত্পাদন বৃদ্ধি ততটুকু সহজ হবে।