Image description

প্রাথমিকেই শিশুর শিক্ষার ভিত তৈরি হয়। কিন্তু যারা সেই ভিত রচনা করেন, সেই শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী! মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাশ একজন ড্রাইভারের গ্রেড ১২তম আর স্নাতক-মাস্টার্স পাশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকের গ্রেড ১৩তম। এ গ্রেড অনুযায়ী তাদের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা এবং বাড়ি ভাড়া, চিকিত্সা ভাতাসহ সর্বসাকল্যে পান সাড়ে ১৯ হাজার টাকার মতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। এদেশের প্রাথমিকের শিক্ষকদের গড় বেতন ১৭০ ডলার ২ সেন্ট, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৬২ ডলার কম। উচ্চমূল্যে খাবার কিনে খেয়ে প্রাথমিকের একজন শিক্ষকের পক্ষে সংসার চালানো পাহাড়সম কঠিন।

বিভিন্ন দেশের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সিংগাপুরসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং বেশি বেতনের চাকরিগুলোর মধ্যে একটি। আর বাংলাদেশে এদিক থেকে তা একেবারেই পেছনের সারিতে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা বলেন, প্রাথমিকের প্রায় প্রতিটি শিক্ষক ঋণে জর্জরিত। কারণ এই বেতনে একজন শিক্ষক পরিবারের ভরণপোষণ ঠিকমতো করতে পারেন না। অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের যোগ্যতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সব সময় গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছে। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ইউরোপের দেশ লুক্সেমবাগ। দেশটির প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৫ হাজার ৯৮৪ ডলার ৩০ সেন্ট। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জার্মানিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৫ হাজার ৭৯৯ ডলার ৯১ সেন্ট। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা সুইজারল্যান্ডের শিক্ষকরা ন্যূনতম ৫ হাজার ৭৯ ডলার বেতন পেয়ে থাকেন। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে সিংগাপুর। দেশটির প্রাথমিক শিক্ষকদের গড় বেতন ৪ হাজার ২০৩ ডলার ২৫ সেন্ট। দেশটির ন্যাশনাল সেন্টার অন এডুকেশন অ্যান্ড দ্য ইকোনমির তথ্য অনুযায়ী শিক্ষকদের পাঁচ ধরনের বেতন কাঠামো রয়েছে, যেখানে মাসে ন্যূনতম বেতন ২ হাজার ৩৫৩ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরবে শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন দেওয়া হয় ৪ হাজার ১৬১ দশমিক ৮৩ ডলার। এছাড়া এশিয়ায় শীর্ষ আটে থাকা অন্য দেশগুলো হলো ওমান, কুয়েত, চীন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান এ মহাদেশের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৪৫তম। বাংলাদেশের চেয়ে যে চারটি দেশ পিছিয়ে সেগুলোর সবই যুদ্ধবিধ্বস্ত। এর মধ্যে লেবাননে একসময় শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হতো এবং শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকেও বেশ এগিয়ে ছিল। বর্তমানে দেশটিতে শিক্ষকদের গড় বেতন নেমে এসেছে মাত্র ১৯ ডলার ২৩ সেন্টে। এছাড়া লাওসে শিক্ষকদের গড় বেতন ১৪৩ ডলার ১৪ সেন্ট, ইয়েমেনে ৭৮ ডলার ৭৪ সেন্ট ও উজবেকিস্তানে ৭৮ ডলার ৭৪ সেন্ট।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষকদের বেতন তুলনা করলে সবার পেছনে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি বেতন পান দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের শিক্ষকরা। দেশটির প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন প্রায় ৯৫৩ ডলার ১৩ সেন্ট, যা বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ গুণ। এমনকি পাকিস্তানেও শিক্ষকদের গড় বেতন ২০৬ ডলার ৭ সেন্ট ও শ্রীলংকায় ২৫০ ডলার ৪৪ সেন্ট। ভারতে রাজ্য ও বিষয়ভেদে শিক্ষকদের বেতনের ভিন্নতা রয়েছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতন কাঠামো নিয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সংস্থাগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারতের শিক্ষকদের গড় মাসিক বেতন ২৮৪ ডলার ৬৪ সেন্ট। এছাড়া ভুটানে প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন ৩৪১ ডলার ৭২ সেন্ট এবং নেপালে ৪৬৭ ডলার ৪৫ সেন্ট। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারেও শিক্ষকদের গড় বেতন ১৮৯ ডলার ২২ সেন্ট।

জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক রয়েছেন। তারা নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় বিগত সময়ে বিভিন্ন দাবি তুলেছেন; কিন্তু সেগুলো পূরণ হয়নি। সর্বশেষ গত ২৪ জানুয়ারি বেতন কাঠামো দশম গ্রেডে উন্নীত করার দাবিতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শিক্ষক সমাবেশ করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সমাবেশ শেষে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে দশম গ্রেড বাস্তবায়নের দাবির স্মারকলিপি জমা দেয়। পরে রাতে আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে দশম গ্রেড বাস্তবায়নের আলটিমেটাম দিয়ে শাহবাগ ছাড়েন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। আজ তাদের আলটিমেটাম শেষ হচ্ছে। দাবি বাস্তবায়ন না হলে শিগগিরই তারা বৈঠক করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুই জন শিক্ষক ইত্তেফাককে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে এ স্তরে যোগ্য শিক্ষক নিশ্চিত করা এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ানো ও বেতন বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষকতা একটি মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানজনক পেশা। শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতনও উচ্চতর স্কেলে দেওয়া হয়। শিক্ষকেরা আর্থিক সুবিধা ছাড়াও রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। সে হিসাবে আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এখনো সেইভাবে রাষ্ট্র দিতে পারেনি, এ জন্যই শিক্ষকেরা এখনো সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি। আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন সরকারের একজন গাড়ির ড্রাইভারের চেয়েও কম! এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় এখন অনেক মেধাবী শিক্ষক এলেও তাদের অনেকেই কম বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার কারণে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। আবার দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেকেই দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।

প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের নেতা ও বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি শাহীনুর আল আমিন বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। এটি দেশের জন্য লজ্জার। তিনি বলেন, অষ্টম শ্রেণি পাশ একজন সরকারি গাড়িচালক ১২তম গ্রেডে বেতন পান, উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিপ্লোমা পাসের যোগ্যতায় নার্সরা জাতীয় পে-স্কেলের দশম গ্রেড পাচ্ছেন, উচ্চ মাধ্যমিকসহ চার বছরের ডিপ্লোমা যোগ্যতায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা দশম গ্রেড, পুলিশের এসআইরা স্নাতক যোগ্যতায় দশম গ্রেড এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় দশম গ্রেড পাচ্ছেন। অথচ স্নাতক পাস একজন প্রাথমিক শিক্ষক পান ১৩তম গ্রেড। এখন যেহেতু বৈষম্যবিহীন সরকার দায়িত্বে, তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে বেতন দেওয়ার জন্য আমরা আন্দোলন করছি। 

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, আন্দোলন-কর্মসূচি দিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি তুলে ধরলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বৈষম্য দূর হচ্ছে না খুব সহজে। এখনো প্রধান শিক্ষকরাই দশম গ্রেড পাননি। আর সে কারণে সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তবে প্রধান শিক্ষকদের ১১ গ্রেড থেকে দশম গ্রেড দিতে সরকারের মনোভাব ইতিবাচক। যদিও প্রধান শিক্ষকরা আন্দোলন-কর্মসূচি দিয়ে দাবি করেছেন নবম গ্রেড।