Image description

বাংলাদেশে ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষে প্রাণহানির নজিরবিহীন ঘটনা এবং ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের অতিমাত্রায় দৃশ্যমান হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত আবারো দুই পক্ষের আলাদা আয়োজনে ঢাকার কাছে টঙ্গীতে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা।

ইজতেমার আয়োজনকে কেন্দ্র করে বিবদমান দুই পক্ষ – মাওলানা জুবায়ের অনুসারী ও মাওলানা সা'দ কান্দালভি'র অনুসারীরা গত ১৮ই ডিসেম্বর টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে যে সংঘর্ষে জড়ান তাতে এ পর্যন্ত মোট চার জন মারা গেছেন।

এর মধ্যে একজন গত মঙ্গলবার মারা গেছেন, যিনি সংঘর্ষে আহত হয়ে এতদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন।

প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবারেও দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন করবে দুই পক্ষ। শুক্রবার জুবায়েরপন্থীদের ইজতেমা শুরু হবে, যা শেষ হবে দোসরা ফেব্রুয়ারি।

আর সা'দপন্থীরা দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমার আয়োজন করবেন ১৪ থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারি। ইজতেমা শেষে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে প্রশাসনের কাছে।

অন্যদিকে তাবলীগ জামাতের মূল কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ এখন কার্যত জুবায়েরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। তারা সা'দ পন্থীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধেরও দাবি জানিয়েছে।

সা'দপন্থীদের শীর্ষ নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তাবলীগকে জড়িয়ে এ সংকটের মূল কারণ হলো ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা।

"আমাদের এখানে সমস্যা হলো ধর্মভিত্তিক দলগুলো সাথে জুড়েছে। তারা মাদ্রাসা থেকে ছাত্রদের বের করে এনে হামলা করায়। এদের কারণেই ঘটনাগুলো রাজনৈতিক রূপ নেয়," বলছিলেন তিনি।

সা'দবিরোধী অংশের নেতা মাওলানা জুবায়ের আহমেদের ঘনিষ্ঠ মাহফুজ হান্নান বলেছেন, তাবলীগ রাজনৈতিক রূপ পায়নি। "বরং এখন যে সংকট তার জন্য দায়ী হলেন সা'দ কান্দালভি । এবারের পর সা'দপন্থীদের আর ইজতেমাই আয়োজন করতে দেয়া হবে না," বলছিলেন তিনি।

১৯৬৭ সাল থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্ব ইজতেমা। দেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নেন।

১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই টঙ্গী ইজতেমায় আরও কিছু দেশ থেকে আসা বিপুল সংখ্যক মুসল্লি যোগ দিচ্ছেন। একই সময়ে পাকিস্তানের লাহোরের কাছে রায়উইন্ড শহরে ও ভারতের ভোপালে বড় ইজতেমার আয়োজন করা হয়।

এই দুই ইজতেমার চেয়ে টঙ্গীর ইজতেমায় বেশি মুসল্লি যোগ দিলে তা পরবর্তীতে 'বিশ্ব ইজতেমা' হিসেবে পরিচিতি পায়।

মাওলানা মোহাম্মদ সা'দ কান্দালভী

ছবির উৎস,Youtube

ছবির ক্যাপশান,ভারতীয় তাবলীগ জামাতের শীর্ষ নেতা মাওলানা মোহাম্মদ সা'দ কান্দালভী

সংকট ও রাজনৈতিক রূপ

তাবলীগ-জামাতের শীর্ষ নেতা ও ভারতীয় নাগরিক মোহাম্মদ সা'দ কান্দালভির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক তাবলীগ জামাতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল।

এর প্রভাবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, সুদান, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশে তাবলীগ জামাত বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশে ইজতেমা দুই পর্বে বা আলাদাভাবে আয়োজন করা হয় না।

ওই বিরোধের পর থেকে বাংলাদেশে দুই গ্রুপ আলাদা হয়ে দুই পর্বে ইজতেমা আয়োজন করছে। বিরোধিতার কারণে ২০১৮ সাল থেকে ইজতেমায় আসতে পারছেন না সাদ কান্দালভি।

"গত ৭০ বছর তাবলীগ চলছে দিল্লিতে নিজামুদ্দিন মারকাজের নির্দেশনায়। সারা দুনিয়াতেই তাবলীগ তাদের নির্দেশনায় পরিচালিত হয়। ৫/৬ বছর আগে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের একটি অংশ আলাদা হয়েছে। তারা সা'দ কান্দালভিকে মানতে চাইছে না," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম।

তার দাবি, "আসলে বিষয়টি হলো নিয়ন্ত্রণ নেয়া, রাজনীতি করা। কিছু রাজনৈতিক দল এর সাথে যুক্ত হওয়ার পরই সমস্যা তৈরি হয়েছে।"

তবে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন জুবায়েরপন্থী অংশের মাহফুজ হান্নান। তার দাবি রাজনৈতিক কোনো প্রভাব এক্ষেত্রে কাজ করছে না।

"কাকরাইলের মুরব্বিরা যেভাবে বলেন সেভাবেই পরিচালিত হয় সবকিছু। ভবিষ্যতেও তাই হবে। কোনো রাজনৈতিক নেতার বিষয় এখানে নেই," বলছিলেন তিনি।

যদিও গত ১৮ই ডিসেম্বরের সংঘর্ষের পর সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে গত কয়েক বছরে নানা ঘটনায় আলোচনায় আসা খেলাফত মজলিস নেতা মামুনুল হকসহ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে, যারা বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতা।

এর আগে ২০১৩ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতের আবির্ভাবের পর সেটিকে অরাজনৈতিক সংগঠন আখ্যায়িত করে তাতে সংযুক্ত হয়েছিলেন এসব নেতাদের অনেকে।

তাবলীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যেখানে খেলাফত মজলিস নেতা মামুনুল হকও উপস্থিত ছিলেন

ছবির উৎস,BD Ministry of Home Affairs

ছবির ক্যাপশান,তাবলীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যেখানে খেলাফত মজলিস নেতা মামুনুল হকও উপস্থিত ছিলেন

সা'দপন্থীরা মনে করেন এসব নেতারাই পরে ইজতেমা নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দেন।

"তারা মাদ্রাসা থেকে ছাত্রদের এনে হামলা করান। আবার মসজিদেও আক্রমণ করান," বলছিলেন সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম।

হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। "এখানে হেফাজতকে টেনে আনলে চলবে না। সংকটের জন্য দায়ী সাদ কান্দালভি। সহিংসতা তার লোকেরাই করছে," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

এর আগে গত সাত বছর ধরে প্রশাসনের সিদ্ধান্তে কাকরাইল মসজিদে অবস্থানের ক্ষেত্রে সা'দবিরোধী অংশটি যারা জুবায়েরপন্থি হিসেবে পরিচিত, তারা চার সপ্তাহ ও সা'দপন্থিরা দুই সপ্তাহ করে পর্যায়ক্রমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন।

গত বছর পাঁচই নভেম্বর সা'দবিরোধী ওলামা মাশায়াখরা ঢাকায় সমাবেশ করে সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ করাসহ নয় দফা দাবি জানায়। এই সমাবেশের আগে তাবলীগের দুই গ্রুপই পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ডাক দিলে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সা'দপন্থীরা তখন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।

পরে সমাবেশে সাদবিরোধীরা দুটির বদলে একটি ইজতেমা করা এবং সেই ইজতেমায় সাদ কান্দালভিকে আসতে না দেয়া এবং কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থীদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেয়। জবাবে সা'দপন্থীরাও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা করে।

সেই সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের নেতা শাহ মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী মোনাজাত পরিচালনা করেছেন। এই সমাবেশ আয়োজনের পেছনেও ধর্মভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিলো, দাবি করছেন সা'দপন্থীরা।

মাহফুজ হান্নান বলছেন, "সরকার এবার শর্তসাপেক্ষে সা'দপন্থীদের ইজতেমার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এরপর তারা আর ইজতেমা আয়োজনের সুযোগ পাবে না। এটাই তাদের জন্য শেষ সুযোগ। সংঘাত সহিংসতা করে তারা এখন ইজতেমায় রাজনীতি খুঁজতে চাইছে।"

তাবলীগ জামাতে বিভক্তি দেখা দেওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,তাবলীগ জামাতে বিভক্তি দেখা দেওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে

কী নিয়ে বিতর্ক

তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষের লোকজনের কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো–– সা'দ কান্দালভি আলেমদের বিষয়ে এমন কিছু 'সংস্কারের' কথা বলছেন যা সংগঠনের ভেতরে অনেককে ক্ষুব্ধ করেছে।

২০১৭ সালে তার যে বক্তব্যটি সামনে এসেছে তা হলো–– ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়।

তিনি আরও বলেছেন, মাদ্রাসাগুলোর যারা শিক্ষক তারা মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ পড়েন যা ঠিক নয়। তাদের মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।

তার এ বক্তব্য অনেককে, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেমদের দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করে।তারা মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।

তাদের দাবি- সা'দ কান্দালভি যা বলছেন তা তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের নির্দেশিত পন্থার বিরোধী এবং আহলে সুন্নাত ওয়া'ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেমদের আয়ের বড় একটি উৎস হলো অর্থের বিনিময়ে ওয়াজ করা। অথচ সা'দ কান্দালভি অর্থের বিনিময়ে ধর্ম প্রচারের বিরোধী।

ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন কয়েক লাখ মানুষ

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন কয়েক লাখ মানুষ

বিশ্লেষকের বক্তব্য

ইসলাম বিষয়ক লেখক ও বিশ্লেষক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলছেন, তাবলীগ জামাতের বিভক্তির জন্য রাজনৈতিক কারণের চেয়ে বেশি দায় হলো নেতৃত্ব, ধর্মীয় ব্যাখ্যাগত ও আকিদাগত বিচ্যুতি।

"রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংযুক্তির কারণে সমস্যা হয়েছে বিষয়টি এমন না। বাংলাদেশে সাদ কান্দালভিতে প্রতিক্রিয়া হয়েছে বেশি। কারণ প্রবীণদের সাথে তার দূরত্ব হয়েছে দিল্লিতে। উনার কিছু ভাষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি – পরম্পরায় চলে আসা ব্যাখ্যার থেকে ভিন্ন, যা বিতর্ক তৈরি করেছে," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

তিনি জানান, সাদ কান্দালভির কিছু কথার প্রতিবাদ শুরু হলে ২০১৬-১৭ সালের দিকে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলেমদের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়।

"যদিও আগেও তারা সম্পৃক্ত ছিলেন কিন্তু সেটা এখনকার মতো দৃশ্যমান ছিল না। এক পর্যায়ে হেফাজত ও বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের কেউ কেউ যুক্ত হয়েছেন।"

শরীফ মুহাম্মদ বলেন, এখন রাজনৈতিক আলেমদের বেশি চোখে পড়ছে এটি সত্যি। কিন্তু এর একটি বড় কারণ হলো অরাজনৈতিক আলেমরা সামনে আসেন না।

"তারা হয়তো গণমাধ্যম কিংবা জাতীয়ভাবে সেভাবে পরিচিত নন। ফেস ভ্যালু কিংবা উত্তাপমুখর বক্তব্য দেয়ার কারণে রাজনৈতিক কেউ কেউ বেশি চোখে পড়ছেন। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আলেমরা ধর্মীয় ইস্যুতে সক্রিয় হওয়া শুরু হয়েছেন সেই আশির দশক থেকেই," বলছিলেন তিনি।