যুগ যুগ ধরে এখনও সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলা একটি মুখরোচক খাবার বিস্কুট। বিগত এমনকি চলতি দশকে বড় হওয়া বাচ্চাগুলোর মুখেও শোভা পেতো, 'মা বিক্কুট'। সে হয়তো ঠিক মতো উচ্চারণও করতে পারতো না তবে তার সেই আবেদনজুড়ে ছিল বিস্কুটের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা। বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ থেকে শুরু করে অনেকের কাছেই বিস্কুট এখনও সমানভাবে জনপ্রিয়। এই বিস্কুট কম আয়ের মানুষগুলোর জন্য অন্যতম প্রধান খাবার এবং লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীদের জন্য পুষ্টির অত্যাবশ্যক উৎস।তবে শঙ্কার বিষয় হলো এই মুখরোচক খাবারটির উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল লোকেদের জন্য এটি ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার বড়সড় একটি ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি "মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫"-এ উল্লেখিত বিস্কুট সহ কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য সামগ্রীর উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ৫% থেকে ১৫% বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা কেবল হুমকির মুখেই পড়েনি বরং এই শিল্প, জীবন- জীবিকা এবং অগণিত নিন্ম আয়ের নাগরিকের কাছে কঠিন এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হঠাৎ করে তিনগুণ কর বৃদ্ধির ফলে এর একটি প্রবল প্রভাব পরতে যাচ্ছে সবচেয়ে দরিদ্র এবং সবচেয়ে দুর্বল সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে যা ক্ষতিগ্রস্ত করবে তাদের প্রাত্যহিক জীবনকে। সাধারণত বিস্কুট সহজলভ্য হওয়ায় খুবই কম দামে বিক্রি হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই খাবারটি স্কুলগামী ছোট ছোট শিশু, সুবিধাবঞ্চিত যুবক এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য একটি পুষ্টিকর জীবনরেখা হয়ে এসেছে। তবে অনেকটা ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নির্মাতারা আর এতো কম দামে বিস্কুট উৎপাদন করতে পারবেন না, ফলে হুমকির মুখে অনেকের ভরণপোষণের এই অপরিহার্য উৎসটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়াও এর ফলে জনজীবনে বেশকিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
১. পুষ্টি এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রভাব
প্রধানত শিশু এবং ছাত্রদের জন্য, বিশেষ করে গ্রামীণ এবং নিম্ন আয়ের শহুরে অঞ্চলে, বিস্কুট জলখাবারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেননা এগুলো শক্তি এবং পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলের দিন জুড়ে শক্তিমান থাকার জন্য বিস্কুটের মতো সাশ্রয়ী মূল্যের খাবারের বিকল্পের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এই সহজলভ্য পণ্যগুলিকে দুর্গম করে, কর বৃদ্ধি করে শিশু পুষ্টির উন্নতি এবং অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করার জাতীয় প্রচেষ্টাকে দুর্বল করা হবে। ফলশ্রুতিতে এটি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে আরও তীব্রতর করে তুলবে, বিশেষ করে সেই সকল পরিবারগুলির মধ্যে যারা ইতিমধ্যেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে।
২. অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণতি
সাধারণত মুখরোচক এই খাবারটি এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছে। এই শিল্পগুলোতেই কেবল আড়াইশো হাজারেরও বেশি শ্রমিকের জন্য বড় বাঁধার সৃষ্টি করবে, যাদের মধ্যে অনেকেই নিম্ন-আয়ের। এছাড়াও এর কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রান্তিক কৃষকদেরও অর্থনৈতিক দিকটিতে বড় ভূমিকা রাখে। তাই একদিকে যেমন বর্ধিত ভ্যাট উৎপাদন খরচ বাড়াবে তেমনি কমিয়ে দেবে চাহিদা। যার ফলে অনেক ব্যবসায়ীই ক্ষতির মুখে কাজ কমাতে বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
যার ফলাফল হবে খুবই ভয়াবহ! কেননা চাকরি হারাবে অনেকেই আবার দেখা দেবে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এমতাবস্তায় কম চাকরি এবং ক্রয় ক্ষমতা হ্রাসের সাথে সাথে, সম্প্রদায়ের সামাজিক কাঠামো গুরুতর চাপের সম্মুখীন হবে, সম্ভাব্য অশান্তি এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করবে দেশকে।
৩. রফতানি এবং জাতীয় উন্নয়নের জন্য একটি আঘাত
জনপ্রিয় এই বিস্কুট শিল্প কেবল দেশীয় অঙ্গনেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। পৃথিবীর ১৪৫ টিরও বেশি দেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রেখে চলেছে এই খাতটি। তবে এমন করে নির্মাতাদের উপর বর্ধিত বোঝা বিশ্বব্যাপী প্রাচীন এই বাজারকে সংকুচিত করবে, হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে শিল্পের প্রতিযোগিতা যার ফলে রফতানি ঝুঁকি সৃষ্টি এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখে দিতে পারে।
তাছাড়াও এই সিদ্ধান্তটি কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বৃদ্ধিকে সমর্থন করাকে বিরোধিতা করে। নতুন এই কর বৃদ্ধি বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিকে সমর্থন করার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে এবং জিডিপি বৃদ্ধি এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখার ক্ষেত্রে শিল্পের সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ণ করে।
৪. পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন
নতুন এই কর নীতি হতে পারে অতীব ভয়ঙ্কর। এর ফলে জনজীবন হতে পারে বিধ্বস্ত। প্রাচীন এই শিল্পের ক্ষেত্রে হুমকি ছাড়াও এর ফলে পুষ্টি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের সামগ্রিক কল্যাণকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
তাই সরকারকে অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করতে হবে এবং প্রত্যাহার করতে হবে। বিস্কুটের মতো অত্যাবশ্যকীয় একটি খাদ্যের উপর ট্যাক্স,রেয়াত বৃদ্ধি কোনভাবেই সুফল বয়ে আনবে না। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই উৎপাদন শিল্পটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের ঐতিহ্য হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আমাদের দেশে এমন অযৌক্তিকভাবে ভ্যাট বৃদ্ধি এমন ঐতিহ্যকে বাধাগ্রস্থ করবে।
উল্লেখ্য, একটি জাতি হিসাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা করা, বাংলাদেশ এমন নীতিগুলি বহন করতে পারে না যা বৈষম্যকে আরও গভীর থেকে গভীরতর করে তোলে এবং যার ফলে দেশের সবচেয়ে দুর্বল নাগরিকদের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
পাশাপাশি সরকারকে অবশ্যই স্বল্পমেয়াদী রাজস্ব লাভের তুলনায় জনগণের প্রয়োজনকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে, যাতে বিস্কুটগুলোর মতো প্রয়োজনীয় আইটেমগুলো সবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে এবং গ্রহনযোগ্য পর্যায়ে থাকে তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের হঠাৎ এমন অযৌক্তিক হারে জনপ্রিয় এই খাবারের উপর কর বৃদ্ধির ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সচেতন মহলের অনেকেই দাবি তুলেছেন এমন অযৌক্তিক কর-ভ্যাটকে প্রত্যাহার করার জন্য। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ' গরিবের আহার কেড়ে নিবেন না'। খালিদ নামে একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ' হঠাৎ করে তিনগুণ দাম বাড়ানোর মানে কি?' আসনা নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ' এগুলো কি তামাশা শুরু করেছে সরকার?' এদিকে বিশিষ্ট জনদের দাবি দ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।