দীর্ঘ ১৬ বছরের অপেক্ষার অবসান। অবশেষে পরিবারের কাছে, মায়ের কাছে ফিরেছেন সাবেক বিডিআর সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে দীর্ঘ কারাবাসের পর যেন ফিরে পেলেন এক নতুন জীবন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর সন্তানকে ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা ইউসুফের মা। তবে ছেলে ফিরলেও কারাগারে তার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলা ১৬টি বছর কি আর ফিরবে? এ ক্ষতি কি কখনো পূরণ হবে?–এমন প্রশ্ন পরিবারের।
মোহাম্মদ ইউসুফ উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের টেকনিক্যাল কলেজ গেইট সংলগ্ন মোহাম্মদ ইলিয়াছের ছেলে। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি প্রথম। ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ ২০৫ জন বিডিআর সদস্যকে খালাস দিয়েছেন তারমধ্যে মোহাম্মদ ইউসুফ একজন। তিনি গত ২৩ জানুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে অসুস্থ্য অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে ২৬ জানুয়ারি নিজ বাড়িতে ফিরেন। তখনকার অবিবাহিত এই যুবকের বয়স এখন ৪০ বছর। কারামুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলে এলাকাবাসীও ইউসুফকে সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে স্বাগতম জানান।
কেমন ছিল জীবন থেকে হারিয়ে ফেলা ১৬ বছর? জানতে চাইলে মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘আমি ২৪ বছর বয়সে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে বিডিআর’এ যোগ দিই। তখন আমি ডিগ্রি’র ছাত্র। পরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯ তারিখের ঘটনায় এপ্রিল গণগ্রেফতারের আমিও গ্রেফতার হই। ওই সময় আমি কেন্দ্রীয় বিডিআর হাসপাতালে কর্মরত ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়। যদিও এসবের কিছুই আমি জানতাম না। ওই মামলায় প্রথম দুই বছর (২০০৯-১০) কাশিমপুর কারাগারে পরে বাকি সময়টা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে রাখা হয়। ২০১৩ সালে হত্যা মামলা থেকে খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই কাটাতে হয়।
আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, জেল থেকে মুক্ত হয়েছি এ জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্থরের জনগণের প্রতি। সবার কাছে একটাই প্রত্যাশা আর কোনো নিরাপরাধ বিডিআর যেন এই শাস্তি না পান। যারা নিরাপরাধ তারা যেন আমার মতো মায়ের কোলে ফিরে আসেন। তবে অপরাধীদেরও শাস্তি কামনা করছি।
সাবেক এই বিডিআর সদস্য বলেন, ছয় ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে, পরিবারের হাল ধরার জন্য ও আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে ২০০৮ সালে যোগ দিই বিডিআর এ সৈনিক হিসেবে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। উলটো চাকরিতে যোগদান করতে না করতেই ২০০৯ সালের পিলখানার ঘটনায় আসামি হয়ে চাকরিচ্যুত হতে হয়। পাঠানো হয় জেলে। তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো ১৬ বছর পরেও আমি ফিরে এসে বাবা-মাকে জীবিত পেয়েছি।
মোহাম্মদ ইউসুফকে ফিরে পেয়ে সবচেয়ে বেশি খুশি তার মা’ রানু বেগম। তিনি বলেন, মা হিসেবে সন্তানকে ফিরে পেয়েছি এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। বড় সন্তান ইউসুফ বিডিআরের চাকরি পাওয়াতে অভাবের সংসারে আশার বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু এই ঘটনায় অভাবও মিটল না সন্তানের সুখও পেলাম না। আর কোনো মায়ের যেন এই করুণ দশা না হয়। আমার ছেলের মতো যেন আর কোনো নিরাপরাধ সন্তানকে জেল হাজতে থাকতে না হয়।
ইউসুফের ছোট ভাই আবু বক্কও ছিদ্দিক জানান, বড় ভাই জেলে থাকার পর আমার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। পরে জোড়া তালি দিয়ে পরিবারকে ধরা রাখা হয়েছে। ১৬ বছর পর ভাইকে পেয়ে কি যে ভালো লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পুরো এলাকাবাসী আমার ভাইকে স্বাগত জানিয়েছে। এই অবস্থায় অন্তবর্তী সরকারের কাছে দাবি আমার ভাইসহ যেসব নির্দোষ বিডিআর রয়েছে তাদের যেন মামলা থেকে নিষ্পত্তি করা হয়। তাদের চাকরিতে পুনবহালের পাশাপাশি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
ইউসুফের ছোট ভাইয়ের আট বছরের ছেলে সামির জানায়, আমার বড় আব্বুকে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। বড় আব্বুকে আর কোথাও যেতে দেব না।
এদিকে ইউসুফকে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাড়িতে যান পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থদের সংগঠন ‘এক্স বিডিআর কক্সবাজার ২০০৯’। অন্তবর্তী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করার দাবি জানান তারা।
বড় মহেশখালীর মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে সাবেক বিডিআর সদস্য মো. রেজাউল করিম জানান, নিরাপরাধ বিডিআরদের মুক্তি দেওয়ায় অন্তবর্তী সরকাকে ধন্যবাদ জানাই। এই সরকারের কাছে অনুরোধ ক্ষতিগ্রস্থ বিডিআরদের যেন সযোগিতার হাত বাড়ায়। যাদেও এখনো বয়স আছে তাদের যেন পুনরায় চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বিডিআরদের ক্ষতিগ্রস্থ পরিবাকে যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এছাড়া যাদের বয়স নেই তাদেরকে যেন পেনশনের আওতায় আনা হয়।
‘এক্স বিডিআর কক্সবাজার ২০০৯’ এর সভাপতি হাবিলদার মো. একরাম উল হুদা জানান, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে কক্সবাজারের ৫৭ জন বিডিআর ক্ষতিগ্রস্থ। তারমধ্যে ইউসুফ একজন। এর মধ্যে মহেশখালীর শওকত ও সদর উপজেলা খুরুশকুলের কাঞ্চন মারা গেছেন। ইউসুফের জীবন থেকে ১৬টি বছর হারিয়ে গেছে। যা কেউ পূর্ণ করে দিতে পারবে না। অন্তবর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি ইউসুফসহ ক্ষতিগ্রস্ত বিডিআরদের যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্থ বিডিআরদের মানবেতর দিন কাটছে।
ইউসুফের বাড়িতে শুভেচ্ছা জানাতে যাওয়া ‘এক্স বিডিআর কক্সবাজার ২০০৯’ এর অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন, রেজাউল করিম, শামশুল আলম, কৃষাণ কান্তি দে, মো. ধুধু মিয়া, সাইফুল ইসলাম, খোরশেদ আলম, জহির উদ্দিন ও আবু বক্কর ছিদ্দীক।
সারাবাংলা