Image description
 

বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে রাজধানীর বাইরে বিভাগীয় সদরে হাই কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব করছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে উপজেলা পর্যায়েও আদালতের কার্যক্রম সম্প্রসারণ সুপারিশ থাকছে কমিশনের প্রতিবেদনে। স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচার কার্যক্রম আরও গতিশীল ও কার্যকর করতে ৩২ বিষয়ে সুপারিশ নিয়ে প্রতিবেদন ৫ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেবে কমিশন।

প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ, শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা এবং অপসারণ, ফৌজদারি অপরাধ তদন্তে পুলিশের বাইরে স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয়, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট সংবিধানের বিধানগুলো সংশোধনী; অধস্তন আদালতের সাংগঠনিক কাঠামো, জনবল, নিয়োগ পদ্ধতি এবং নতুন পদ সৃজন; পর্যাপ্ত বাজেট, ভৌত অবকাঠামো ও লজিস্টিক ব্যবহার; বিচার কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার; বিচার বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন বাস্তবায়ন বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

একই সঙ্গে আইনি সহায়তা বাড়ানো; বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি; মামলাজট হ্রাস; বিচারক ও সহায়ক জনবলের প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ও গণসচেতনা সৃষ্টির বিষয়ে সুপারিশ স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া মামলা ব্যবস্থাপনা, গ্রাম আদালত, মোবাইল কোর্ট, আইনজীবীদের যোগ্যতা, আইন শিক্ষার সংস্কার এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিষয়ে সুপারিশ থাকবে প্রতিবেদনে। 

রাষ্ট্রকাঠামোয় ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে বিচার বিভাগসহ ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে গত ৩ অক্টোবর আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠিত হয়।

জানতে চাইলে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন বলেন, আমাদের প্রতিবেদন একদম প্রস্তুত। আমরা ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন জমা দেব। তিনি বলেন, স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিচার বিভাগের কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতিশীলতা আনতে আমরা বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরেছি।

বিভাগীয় সদরে হাই কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ : প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপে বলা হয়েছে, রাজধানীর বাইরে বিভাগীয় সদরে হাই কোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের জন্য কিছু আইনি বৈশিষ্ট্য ও বাস্তব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়ন ও সংশোধনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রতিটি স্থায়ী বেঞ্চ কোন কোন এলাকা থেকে মামলা নিতে পারবে তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তবে বিচারকার্য পরিচালনা এবং রায়, আদেশ, নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে হাই কোর্ট বিভাগের পূর্ণাঙ্গতা বজায় রাখতে হবে।

উপজেলা পর্যায়ে আদালত সম্প্রসারণ : উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্যও প্রস্তাব করছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। সার-সংক্ষেপে বলা হয়েছে, উপজেলা সদরের ভৌগলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা-সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং মামলার চাপ বিবেচনা করে কোন উপজেলায় আদালত স্থাপিত হবে তা নির্ধারণ করতে হবে।

স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা : ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য পৃথক স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন সার্ভিস বা ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস নামে এই সংস্থা হবে পুলিশ বাহিনী থেকে আলাদা একটি কাঠামো। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীর অধীনে প্রচলিত তদন্ত ব্যবস্থা এবং তাতে নিয়োজিত জনবলকে সংগঠিত করার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত প্রক্রিয়ার যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব এবং প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠন প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে। তদন্ত সংস্থায় নিয়োজিত জনবল পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। তাদের নিয়োগ, চাকরির শর্তাবলি, নিয়ন্ত্রণ, ও আনুষঙ্গিক বিষয় একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে। মামলা হওয়ার পরই কেবল তদন্ত সংস্থা কাজ শুরু করবে।

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন : সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে ঘোষিত নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের মূলনীতিকে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে অর্থবহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কমিশন সুপারিশ তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথকীকরণের জন্য পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন করতে হবে। এ জন্য একটি আইন বা অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে হবে।

স্থায়ী স্বতন্ত্র অ্যাটর্নি সার্ভিস : রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্থায়ীভাবে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগের পরিবর্তে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে। এরূপ অ্যাটর্নি সার্ভিসের উদাহরণ প্রতিবেশী দেশগুলোসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত সার্ভিসের দুটি ইউনিট থাকবে। এর মধ্যে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলদের সমন্বয়ে সুপ্রিম কোর্ট ইউনিট গঠন হবে। পাশাপাশি সহকারী জেলা অ্যাটর্নি, সিনিয়র সহকারী জেলা অ্যাটর্নি, যুগ্ম জেলা অ্যাটর্নি, অতিরিক্ত জেলা অ্যাটর্নি এবং জেলা অ্যাটর্নির সমন্বয়ে গঠিত হবে জেলা ইউনিট।