বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী সেবামূলক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম গত বছর (২০২৪) বেওয়ারিশ ৫৭০টি লাশ দাফন করেছে। পুলিশের সঠিক তদন্তে গাফিলতি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সার্ভারে তাদের তথ্য না থাকায় স্বজনদের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা যায়নি।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সূত্রে জানা গেছে, তারা গত বছরের জানুয়ারিতে ৪৪, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩, মার্চে ৪৯, এপ্রিলে ৩৭, মে মাসে ৫৯, জুনে ৪৮, জুলাইতে ৮১, আগস্টে ৩৪, সেপ্টেম্বরে ৩৪, অক্টোবরে ৪৪, নভেম্বরে ৫৩ ও ডিসেম্বরে ৫৪টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে। সংস্থাটি বলছে, এর আগের তিন বছরের মধ্যে ২০২১ সালে ৪৬৫ জন, ২০২২ সালে ৪৪৩ জন, ২০২৩ সালে ৪৯০ জনের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়।
সূত্র জানায়, লাশগুলো শাহবাগ থানার মাধ্যমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও শেরেবাংলানগর থানার মাধ্যমে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হস্তান্তর করে। এ ছাড়া স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, কমলাপুর রেলওয়ে থানাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে লাশগুলো আসে, যা বেওয়ারিশভাবে মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় সবারই শনাক্তকরণের জন্য নিজস্ব পরিচিতি আছে। ওই দেশগুলোতে পুলিশ ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে দ্রুত লাশের পরিচয় শনাক্ত করে ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো জন্ম নিবন্ধনেও আঙুলের ছাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা দরকার। যারা এনআইডি অন্তর্ভুক্তির বাইরে আছে, তাদের আওতায় নিয়ে আসতে নির্বাচন কমিশনকে আরো সক্রিয় থাকতে হবে।
পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) একজন কর্মকর্তা বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ হয়, প্রথমে পরিবারকে থানাসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় জানাতে হয়। কিন্তু পরিবার অনেক সময় পাঁচ-সাত দিন পরে থানায় জিডি করে। এ ক্ষেত্রে মামলার মতো ভালোভাবে তদন্ত হয় না।
জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল ফরেনসিক প্রধান কাজী গোলাম মোখলেসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এখানে ২০২৪ সালে মোট দুই হাজার ৯৬টি ময়নাতদন্ত হয়। এর মধ্যে অজ্ঞাত (বেওয়ারিশ) হিসেবে ময়নাতদন্তের পর পুলিশের সহযোগিতায় আঞ্জুমানকে দেওয়া হয়েছে ২৭৭টি মরদেহ। বর্তমানে এখানে আন্দোলনের সাতটিসহ বেশ কয়েকটি মরদেহ রয়েছে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন সেবা কর্মকর্তা কামরুল আহমেদ বলেন, ‘যদি কখনো কোথাও বেওয়ারিশ লাশ থাকে, দীর্ঘদিন ধরে কেউ লাশের খোঁজ নিচ্ছে না, তখন সেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের খবর দেওয়া হয়। আমরা তখন এসব লাশ আমাদের নির্ধারিত কবরস্থানে নিয়ে রীতিনীতি অনুযায়ী দাফন করে থাকি।’
সূত্র বলছে, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা লাশগুলোর মধ্যে গত জুলাই মাসের এক তারিখ থেকে আগস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১১৫ জনের লাশ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। তাদের মধ্যে একজন বিদেশি নাগরিক ছিলেন। তাঁকে সেই দেশের অনুরোধে বাংলাদেশে দাফন করে আঞ্জুমান।
রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অজ্ঞাতপরিচয় লাশগুলো কবরস্থানটির ৪ নম্বর ব্লকে সারিবদ্ধভাবে দাফন করা হয়। তবে এসব কবরের কোনোটাতেই নেই কোনো নামফলক, চিহ্ন বা সাইন বোর্ড। নতুন কবরগুলো বাদে বেশির ভাগ কবরেরই উঁচু ঢিবি সমান হয়ে গেছে।
ঢাকা মেডিক্যালের মর্গ সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় অনেক লাশ মর্গে আসে। এ লাশগুলোর বেশির ভাগই তাদের স্বজনরা শনাক্ত করে নিয়ে গেছে। আর দীর্ঘদিন মর্গে রাখার পরও যেসব লাশের নাম-ঠিকানা বা পরিচয় পাওয়া যায়নি, তাদের শাহবাগ থানার মাধ্যমে আঞ্জুমানের কাছে দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়।
রায়েরবাজার কবরস্থানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা মাওলানা ফেরদৌস বলেন, ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম থেকে সাধারণত গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরিয়ে আমাদের কাছে আনা হয়। এরপর আমরা শুধু দাফন করি। অনেক সময় স্বজনরা এসে কবর শনাক্ত করার চেষ্টা করে। তবে কোনটা কার কবর বলা খুব মুশকিল। যদি কারো পরিচয় মেলে তার লাশ উঠিয়ে নেয় না তারা। এখানেই থাকে।’
রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দায়িত্বে থাকা গোলাম রব্বানী বলেন, বেওয়ারিশ লাশ দাফনের ক্ষেত্রে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম শুধু কাফনের কাপড় দেয়। বাঁশ, চাটাইসহ অন্যান্য খরচ কবরস্থানের পক্ষ থেকে বহন করা হয়। মাস শেষে এসবের হিসাব সিটি করপোরেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’