বন্ধু-বান্ধব বা পারিবারিক কোনো দাওয়াত কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে আড্ডা, এক চুমুক কোমলপানীয় ছাড়া যেন জমেই না। যে কোনো উপলক্ষ উদযাপনে হাতে চাই কোলা, জুস, আর্টিফিসিয়াল/ফ্লেভার ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস কিংবা ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস।
কিন্তু জীবনযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ এই পণ্যের ওপর ৫ থেকে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়িয়েছে সরকার। নতুন করে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এরই মধ্যে বর্ধিত ভ্যাট-ট্যাক্স কার্যকর হয়ে গেছে। কিন্তু ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে এবং বিক্রি কমার শঙ্কায় এখনো পণ্যের দাম বাড়াননি উৎপাদকরা। এতে ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
ষাটের দশকে বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে কোমলপানীয়র বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য কোকা-কোলা। তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের বাজারে তারা একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। নব্বই দশকের শেষে দেশীয় বেভারেজ প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে।
দেশে কোমল পানীয়ের বাজারের আকার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। বিদেশি কোমল পানীয় প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা ও পেপসিকোর পাশাপাশি আকিজ, প্রাণ, মেঘনা ও পারটেক্সের মতো বেশ কয়েকটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এই চাহিদা পূরণ করে। কোমলপানীয় বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় কোম্পানি।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, দেশে কোমলপানীয়ের বাজারের আকার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। বিদেশি কোমলপানীয় প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা ও পেপসিকোর পাশাপাশি আকিজ, প্রাণ, মেঘনা ও পারটেক্সের মতো বেশ কয়েকটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এই চাহিদা পূরণ করে। কোমলপানীয় বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় কোম্পানি। তবে বাড়তি ভ্যাট-ট্যাক্সের বাধায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পটির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আর্টিফিসিয়াল/ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসে সরবরাহ পর্যায়ে আগে কোনো সম্পূরক শুল্কই ছিল না। এসব ড্রিংকসের কার্বোনেটেডে ৩০ শতাংশ ও নন-কার্বোনেটেডে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
বর্ধিত ভ্যাট-ট্যাক্সের বোঝা
চলতি অর্থবছর ফলের রস ও ফ্রুট ড্রিংকসে সরবরাহ পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ছিল ১০ শতাংশ। গত ৯ জানুয়ারি তা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলের রস আমদানিতে আগে সম্পূরক শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ। তা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
আর্টিফিসিয়াল/ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসে সরবরাহ পর্যায়ে আগে কোনো সম্পূরক শুল্কই ছিল না। এসব ড্রিংকসের কার্বোনেটেডে ৩০ শতাংশ ও নন-কার্বোনেটেডে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প এবং তেঁতুলের পেস্টে আগে ভ্যাট ছিল ৫ শতাংশ। এবার তা ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধি এবং নতুন করে আরোপের ফলের জুস, আর্টিফিসিয়াল/ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসের দাম বাড়বে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোমলপানীয়ের ওপর নিট করহার বর্তমানে ৫০ শতাংশের বেশি। এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। ভারতে এ খাতে করের হার ৪০ শতাংশ, নেপালে ৩৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কায় ২৯ দশমিক ২ শতাংশ।
‘আমাদের খাদ্যের ব্যয় বেশি। খাদ্যপণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য এই বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে।’ প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী
বাড়তি ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বাড়তি ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি বিকেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) নেতারা।
সাক্ষাৎ শেষে সংগঠনটির নির্বাহী সদস্য প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে বিভিন্ন জুসের দাম ৫ থেকে ৭ টাকা বাড়তে পারে। ২০ টাকার জুস ২৫ টাকা, আর ২৫ টাকার জুস ৩৩ টাকা হবে। জুসে প্রায় ২০ শতাংশ সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি আরোপ হয়েছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ২৫ টাকার জুসের ওপর সাড়ে ৭ টাকা নিতে চাইছে সরকার। বিষয়গুলো বিবেচনা করার জন্য ও করহার আগের জায়গায় নিয়ে যেতে আমরা এনবিআরের কাছে আহ্বান জানিয়েছি।’
ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশে ভ্যাটের হার বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের খাদ্যের ব্যয় বেশি। খাদ্যপণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য এই বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে।’
সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে- জানতে চাইলে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা গঠনমূলকভাবে সরকারকে বোঝাবো। বারবার বোঝাবো। ডায়ালগ, সেমিনার করবো। যেন মানুষ বুঝতে পারে করের হার বাড়িয়ে অতিরিক্ত কর আদায় করা যাবে না। এনবিআর চেয়ারম্যান অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। বলেছেন, আমাদের একটা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবেন।’প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘গত ৯ জানুয়ারি ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ার পরও আমরা এখনো পণ্যের দাম বাড়াইনি। আমাদের লস হচ্ছে, ভীষণভাবে লস দিচ্ছি।’
দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে
এসএমসি এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ নাসির বলেন, ‘ইলেকট্রোলাইট পণ্যটি দেশের বাজারে একেবারে নতুন। আগে বিদেশ থেকে পণ্যটি আমদানি হতো, চোরাই হয়ে পণ্যটি আসত। সরকার প্রচুর রাজস্ব হারাত। এক-দুই বছর হলো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এর উৎপাদন শুরু করেছে। এই পণ্যের ওপর একলাফে বড় অঙ্কের কর বসানো হয়েছে, এতে প্রকারান্তরে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
আকিজ ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের পরিচালক সৈয়দ জহুরুল আলম বলেন, ‘৫০ শতাংশের বেশি উৎপাদন হয় জেনারেটরে। সেখানে জ্বালানি খরচ বাড়ানো হলে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হবে না। তার ওপর যদি বর্ধিত করের চাপ দেওয়া হয় তাহলে ভোক্তাদের জন্য এ ধরনের পণ্য কেনা কঠিন হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগে বেভারেজ খাত নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। তখন একটা সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল এই খাত ঘিরে। বলা হয়েছিল ২০২৫ সালে বেভারেজ খাতের বাজার হবে ২৫ হাজার কোটি টাকার। শুধু সরকারের ভুল নীতির কারণে এটি ১০-১২ হাজার কোটির বাজারে আটকে রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার প্রভাবে দেশীয় বেভারেজ পণ্যের বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। বাংলাদেশ বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিবিএমএ) তথ্য মতে, দেশে সবচেয়ে বেশি কোমলপানীয় বিক্রি হয়েছিল ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে এসে বিক্রি কিছুটা কমলেও সার্বিকভাবে ব্যবসা মন্দ ছিল না। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার প্রকোপে এ ব্যবসা বেশ মন্দার মধ্যে কেটেছে। ২০২২ সালে এসে তা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে দারুণভাবে।
দোকানিদের সঙ্গেও কথা বলে জানা গেছে, দেশীয় কোলা ও জুসের চাহিদা বেশি।
গত শনিবার পল্লবীতে আহমেদ জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মাসুদ আহমেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আগে গরমের সময় কোমলপানীয়র বিক্রি বেশি হতো। এখন সব মৌসুমেই বিক্রি ভালো হয়। জুমার নামাজের পর, স্কুল ছুটির পর বলতে গেলে সারা দিনই জুস, কোলা, লেমন বা ইলেক্ট্রলাইট পানীয় বিক্রি হয়। ১০ জন ক্রেতার মধ্যে সাতজনই দেশীয় কোলা বা জুস কিনতে চায়।
নতুন করে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর পর দাম বাড়েনি জানিয়ে মাসুদ আহমেদ বলেন, দাম বাড়ানোর ব্যাপারে ডিলাররা কিছু বলেননি। যদি পাঁচ থেকে সাত টাকা দাম বাড়ে, তাহলে তো বিক্রি কমে যাবে।