Image description
 

অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে নিজের কোলের উপর দুই বন্ধুর মৃত্যুর দৃশ্য চোখে ভাসছিল গুলিবিদ্ধ ইমন কবীরের। দুই দিন আগেই তারা ইমনের কোলের উপর মৃত্যুবরণ করেছে। আজ নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়ে ছুটছেন হাসপাতালের দিকে। কিন্তু পথে কোনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় তাকে বহনকৃত অ্যাম্বুলেন্স। বন্ধ হয়ে যায় সাইরেন। কেউ একজন গালি দিয়ে বলে ‘ কুত্তার বাচ্চাকে বাঁচাতে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। টেনে বের কর। এখানেই মেরে দেই’। মুহূর্তের মধ্যে ইমনের চোখে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ। আর মনে হয় মাকে দেখা হবে না তার। হাসপাতালে পৌঁছালে হয়তো বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু এরা তো এখানেই মেরে ফেলার কথা বলছে। ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সের চালক পাশ কাটিয়ে গাড়ি টান দিয়ে বের হয়ে যায়। পরে ওই চালক জানান, পুলিশ আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে অ্যাম্বুলেন্স আটকে দিয়েছিল।
ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের বি-ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত মো: ইমন কবীর (২২)। তিনি যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র। গ্রামের বাড়ি যশোর সদরে। ইন্টার্নশিপ করতে এসেছিলেন গাজীপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে। বন্ধুদের সাথে থাকতেন রাজধানীর মেরুল বাড্ডার একটি বাসায়। সপ্তাহে শুক্র ও সোমবার ছিল তার ক্লাস। ইমন বলেন, পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় সপ্তাহের বাকি দিনগুলো তিনি ঢাকায় রাইড শেয়ার করতেন। আর রাতে দু’টি টিউশনি করে নিজের খরচ মেটাতেন। তবে স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। ইন্টার্ন শেষ করে বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।

ইমন বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে যুক্ত হতেন তিনি। ১৭ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালায় পুলিশ। এর পর থেকে ছাত্র-জনতা একাকার হয়ে যায়। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় সেখানে। ১৮ তারিখ সকাল থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় সবধরনের যোগাযোগ। এমনকি ব্রডব্যান্ড লাইনের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। এরপর বিকেল থেকে শুরু হয় ভারী অস্ত্রের গুলি। একের পর এক গুলিতে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে সহযাত্রীদের দেহ। এর মধ্যে দু’জন আমার কোলে মারা যান। একজনের গলার সামনে দিয়ে গুলি ঢুকে ব্যাকবোন ছিঁড়ে বের হয়ে যায়। অপরজনের বুকের ঠিক বাম পাশে গুলিবিদ্ধ। তাদের কারো নাম আমি বলতে পারব না। কোন মায়ের সন্তান তাও জানি না। তবে বুকে গুলিবিদ্ধজন আমাকে দু’বার জিজ্ঞাস করেছিল ‘আমি বাঁচব তো’? আর কোনো কথা বলতে পারেনি। এ ছাড়া দুই দিনে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধকে উদ্ধার করে স্থানীয় নাগরিক হাসপাতালে নিয়ে গেছি। সেখানকার একজন নার্স খুবই আন্তরিকতার সাথে সেবা দিতেন; কিন্তু ১৯ তারিখ যখন নিজেই গুলিবিদ্ধ ওই হাসপাতালে তখন ওই নার্স আমাকে দেখে কেঁদে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি নিজেই আজ গুলিবিদ্ধ’।
ইমন বলেন, ১৯ তারিখ প্রথমে হেলিকাপ্টার থেকে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়। পুরো এলাকা টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এরপর সবাই যখন ছোটাছুটি করতে শুরু করে নিচে ও উপর থেকে চালানো হয় গুলি। আমার দুই পাশে কয়েকজন পাখির মতো গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যায়। তাদের একজনকে ধরতে গিয়ে দেখি আমার বাম পায়ের হাঁটুর নিচে ও পায়ের পাতার উপরের অংশের হাড়-গোশত চামড়া ছিঁড়ে বের হয়ে গেছে। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। রাস্তার পিচ রক্তে ভেসে যায়। এরপর আমাকে প্রথমে নেয়া হয় নাগরিক হাসপাতালে। সেখানে ব্যান্ডেজ করে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে পঙ্গু হাসপাতালের দিকে পাঠানো হয়। কিন্তু ব্যান্ডেজ ভালো না হওয়ায় রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না।

 

কেউ কেউ দ্রুত পৌঁছাতে না পারলে রক্তশূন্যতায় মারা যেতে পারে। এত সময় মৃত্যুভয় না ঢুকলেও ওই শব্দটা কানে আসার পর থেকেই চোখের মধ্যে ভাসতে থাকে আমার কোলের উপর মারা যাওয়া দুইজনের মুখ। অ্যাম্বুলেন্সটিকে আন্দোলনকারীরা নিরাপদে পার করে দিলেও একটি জায়গায় গিয়ে আটকে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় সাইরেন। সেটি ছিল পুলিশের চেকপোস্ট। এরপর একজন পুলিশ গালি দিয়ে বলে, এটাকে টেনে বের কর, এখানেই গুলি করে মেরে দেই। তখন শরীর শীতল হয়ে আসছিল। কিন্তু চালক বুদ্ধি করে পাশ কাটিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে বের হয়ে যান। কিন্তু পঙ্গু হাসপাতালেও কেউ চিকিৎসা দিতে চায়নি। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অনেক পরে ওটিতে নেয়া হলেও মূল চিকিৎসা শুরু করেছে সাত আগস্টের পরে। বর্তমানে ইমনের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো পায়ের পাতায় অনুভূতি নেই। আঙুলগুলো নাড়ানো যাচ্ছে না। আর কোনোদিন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারেন কি না সেটিও জানেন না ইমন।