Image description
 

আমরা সকলকেই বন্ধু হিসাবে দেখতে চাই। কিন্তু কেউ যদি আমাদের বন্ধুর বেশে প্রভু হতে চায়, সেটা আমরা কখনো মেনে নেব না। মানতে দেব না। কারও প্রভুত্ব বাংলাদেশের জনগণ স্বীকার করবে না।’ 

এভাবেই দেশ ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে খালেদা জিয়া ছিলেন আপসহীন। আমৃত্যু এমন অবস্থানের কারণেই আপামরসাধারণ তাকে আপসহীন নেত্রীর খেতাব দেয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার বেশির ভাগ বক্তব্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, একনায়কতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার উপাদান মেলে।

গণতন্ত্রের ধ্বংসস্ত‚পে নতুন স্বপ্ন : রক্তাক্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গভীর অসুস্থতা নিয়েও হাসপাতালে বসে প্রথম ভার্চুয়ালি ভাষণে তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নায়কদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা অবৈধ ফ্যাসিবাদী সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের বীর সন্তানদের, যারা মরণপণ সংগ্রাম করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। শত শত শহীদকে জানাই শ্রদ্ধা। এ বিজয় আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।...এ ধ্বংসস্ত‚পের মধ্যে আমাদের নির্মাণ করতে হবে এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। 

প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিনের বন্দিদশা কাটে খালেদা জিয়ার। রাজধানীর নয়াপল্টনে ৭ আগস্ট বিএনপি কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। এ সময় তিনি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি ভুলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানান। খালেদা জিয়া বলেন, ‘ধ্বংস নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা ও শান্তির মাধ্যমে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই : সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তৎপরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ও খালেদা জিয়াকে দেশত্যাগে নানামুখী চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু ক্রমাগত চাপ উপেক্ষা করে দেশনেত্রী তার এক আবেগঘন বক্তব্যে বলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশ, এই দেশের মাটি ও মানুষই আমার সবকিছু। কাজেই আমি কোনোভাবেই দেশের বাইরে যাব না।’

খালেদা জিয়া অন্যায় করেনি : ২০১৮ সালের ৭ ফেব্র“য়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ফরমায়েশি রায় ঘোষণার মাত্র একদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। ন্যায়বিচার হলে বেকসুর খালাস পাব।’ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘বিচারের নামে প্রহসন হলে সেটি হবে ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।’

কাউকে খাটো নয় : নবম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবে ২০১৩ সালের জুনে তিনি এক দীর্ঘ ভাষণ দেন। এখানেও তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহার, জাতীয় নেতাদের যথাযথ সম্মান প্রদানের কথা বলেন। খালেদা জিয়া তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন নীতির কড়া সমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা কাউকে খাটো করে দেখতে চাই না। সকলকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে চাই। প্রত্যেকের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়নের ভার ছেড়ে দিতে চাই ইতিহাসের ওপর।’

দেশটা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয় : বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর চালানো দমন-পীড়ন এবং অব্যাহতভাবে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে পুলিশি বাধার অংশ হিসাবে রাজধানীর গুলশানে বালুর ট্রাক রেখে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয়। অবরুদ্ধ অবস্থায় তিনি তৎকালীন সরকারের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেন, দেশটা কি আপনার একার। পৈতৃক সম্পত্তি হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের। গুন্ডাবাহিনী দিয়ে, পুলিশবাহিনী দিয়ে আমাদের প্রোগ্রাম বন্ধ করতে চান। সাহস থাকে তো কাউন্টার প্রোগ্রাম করে দেখাবেন। সাহস নেই, দশটা লোকও আসে না। না হলে এমন করুণ পরিণতি হয়। ১৫৪টা সিট আনকন্টেস্ট হয়ে যায়।

তবে ফ্যাসিবাদী সরকারের চরম দমননীতির মধ্যেও খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের উত্তরণের কথা বলে গেছেন। ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর এক বিশাল সমাবেশে তিনি ‘সহায়ক সরকার’-এর দাবি তুলে ধরে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। এছাড়া ১৯৯১ সালে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়ন ভাবনার কথা তুলে ধরেন। এরও আগে আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও তার আপসহীন রাজনৈতিক অবস্থান তাকে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে।