বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিত বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮৩ সালে দলে যোগ দিয়ে হাল ধরেন তিনি। রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়া ছিলেন একজন গৃহবধু। কিন্তু গৃহবধু থেকে রাজনীতিতে নেমে মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই বিএনপিকে ক্ষমতায় নিতে পেরেছিলেন তিনি। হয়েছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীও।
রাজনীতিতে “আপসহীন নেত্রী”—এই খেতাবটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় বেগম খালেদা জিয়ার নামের আগে। কিন্তু কেন? কোন কোন ঘটনা তাকে এই পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে? ইতিহাসে রয়েছে খালেদা জিয়ার সামরিক শাসনের বিরোধিতা, আন্দোলন, গ্রেপ্তার, গৃহবন্দী আর নির্বাচনী লড়াইয়ের টানাপোড়েন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে ব্যর্থ এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন। এর সাত মাসের মাথায় দলটির নেতাকর্মীদের অনুরোধে বিএনপিতে যোগ দেন খালেদা জিয়া। পরে ১৯৮৩ সালে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ১৯৮৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপার্সন হিসেবে নির্বাচিত হন।
তখন দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল ভয়, দমন আর সেনাশাসনের ছায়ায় ঢাকা। অনেক ইতিহাসবিদ বলছেন— এই সিদ্ধান্তই ছিল তার “আপসহীন চরিত্রের” প্রথম বড় প্রকাশ। ১৯৮০-এর দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সংগঠিত প্রতিবাদ ছিল ৭-দলীয় জোটের। এই জোটের নেতৃত্বে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালে প্রথম বড় আন্দোলনে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৮৪ সালে আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৮৭ সালে প্রায় গৃহবন্দী অবস্থায় থেকেও তিনি আন্দোলন থামতে দেননি।
ইতিহাসবিদরা বলেন, এসময়ে কোনো সামরিক সরকারের সঙ্গে আপস না করাই ছিল তার রাজনৈতিক অবস্থানের মেরুদণ্ড। এ কারণেই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অন্যতম “আপসহীন নেতা” বলে অভিহিত করেন।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানেও খালেদা জিয়া ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বের মুখ। দেশবাসী চাইছিল গণতন্ত্র ফিরুক, সেনাশাসনের ইতি ঘটুক। এই আন্দোলনে তিনি কোনো ব্যাকডোর ডিল বা ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে আপস করেননি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে এরশাদের পতন ঘটে, এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পথ তৈরি হয়।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়, এবং বেগম খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তার মেয়াদেই বাংলাদেশ প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠনে তার “অটল অবস্থান”–এর ফল। তখনও বলা হচ্ছিল, তিনি এমন নেতা যিনি স্টেট পলিসিতে কখনো আপস করবেন না।
২০০১–২০০৬ মেয়াদে তিনি নানা রাজনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধের মুখোমুখি হন। বিরোধীদের দাবি, জোট রাজনীতি, এমনকি আন্তর্জাতিক মিত্রদের চাপ— কোনো ক্ষেত্রেই তিনি সহজে সমঝোতায় আসেননি। অনেক বিশ্লেষক বলেন, তার “নীতি ও সিদ্ধান্তে কঠোরতা” এ সময় আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২০১৩ ও ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সংঘাত, ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচন সবমিলিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে সরকার ও আন্তর্জাতিক মহল তার ওপর বিভিন্ন সময় আলোচনা-সমঝোতার চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তার দল জানিয়ে দেয়, তিনি আপসের রাজনীতি করেন না। ২০১৮ সালে দুর্নীতি মামলায় দণ্ড পাওয়ার পর, কারাবাস ও অসুস্থতার মাঝেও তিনি সরকারের প্রস্তাবিত বিকল্প সমঝোতা গ্রহণ করেননি। এই অবস্থানেই তার “আপোসহীন” পরিচয় আরও প্রতিষ্ঠা পায়।