Image description
আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে সুখবর নেই

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে ততই তৈরি হচ্ছে নানা শঙ্কা। নির্বাচন ঘিরে শুরু হয়েছে সন্ত্রাসীদের নানা তৎপরতা। আর বড় শঙ্কা তৈরি করেছে আগ্নেয়াস্ত্র। এবারের নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্র একটা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন আলোচনা খোদ নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ আলোচনায়ও উঠে আসছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী, দাগি আসামি, চরমপন্থি, জঙ্গিরাও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিলেও কোনো সুখবর আসেনি। যার ফলে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। আর সারা দেশের প্রার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, উদ্বেগ, আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। দেশব্যাপী ভোটের মাঠে সন্ত্রাসী ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে সেটি নির্বাচনের আগে শুধু রুটিন কাজ সেরে দায়িত্ব সারবে পুলিশ প্রশাসন নাকি সমস্যার সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিবে সেটি নিয়ে ভাবছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামের অভিযানের কিছু ছিচকে আসামি, কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে গণমাধ্যমে প্রচার করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। আদতে যে শঙ্কা আর উদ্বেগ সেটির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না বরং আরও বাড়ছে। কারণ এখন পর্যন্ত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে প্রকাশ্য গুলি করে হত্যাকারীকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনা ছাড়াও ইতিমধ্যে ভোটের মাঠে গুলি করে হত্যার ঘটনাও অনেক। বেশকিছু ঘটনায় এখন সর্বত্র নিরাপত্তা শঙ্কা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র, কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়া অপরাধী, জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ ও দাগি সন্ত্রাসীরা নির্বাচন প্রভাবিত করার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে সীমান্ত পার হয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র এখন সন্ত্রাসীদের হাতে। এ ছাড়া ছোট বড় সব অপরাধীদের দখলে এখন আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র ইতিমধ্যে বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করা হয়েছে। খুনখারাবি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, প্রকাশ্য প্রদর্শন করছে সন্ত্রাসীরা। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, লুট হওয়া অস্ত্র হাতবদল হয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, চরমপন্থি, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও পেশাদার অপরাধী এমনকি রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হাতে চলে গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পেশিশক্তি প্রদর্শন, এমনকি ভোটের মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে অস্ত্রগুলো ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। তাই নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত-সহিংসতা মোকাবিলায় এসব অস্ত্র উদ্ধার না করা গেলে ঝুঁকি থেকেই যাবে। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত কৌশল পাল্টে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা। তা না হলে নিরাপত্তা আশঙ্কা বাড়তেই থাকবে।

গত মঙ্গলবার আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রশাসন ও পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সুষ্ঠু করার পথে অবৈধ অস্ত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ছড়ানো, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ঢালাও জামিন, সীমান্তে নিরাপত্তার দুর্বলতাসহ নানা চ্যালেঞ্জ ও আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন। বৈঠকে ৮ বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ৮ ডিআইজি, ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, ইসির ১০ আঞ্চলিক কর্মকর্তা, ৬৪ জেলার নির্বাচন কর্মকর্তাসহ মোট ২২৬ জন কর্মকর্তা অংশ নেন। বৈঠকে কর্মকর্তারা সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের জামিন বন্ধ রাখতে বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনায় বসা যায় কিনা, জামিনে থাকা অপরাধীদের গতিবিধি নজরে রাখা, কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের অবাধে মুঠোফোন ব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা, কারাবন্দি অপরাধীদের কর্মকাণ্ড নজরে রাখা, সীমান্তে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়ানো, নতুন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দায়িত্ব পালনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিরাপত্তায় জোর দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ বাহিনীর অভিযান প্রয়োজন বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। 

বৈঠকে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, অপরাধীদের জামিনের বিষয় আলোচনায় এসেছে। যদিও এটি বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, নির্বাচন-পূর্ব সময়ে অপরাধীদের জামিনের বিষয়টি একটু নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সহজ হবে। খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ বলেন, দৌলতপুরে কালু-কাঁকন বাহিনীর সঙ্গে প্রশাসন পেরে উঠছে না। অস্ত্রের ঝনঝনানি, অবৈধ অস্ত্র, এআই ও গুজব্তএগুলো মোকাবিলা করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলেন, সিলেটের তিন দিকে সীমান্ত। অস্ত্র, টাকা ও অপরাধীরা সীমান্ত পার হয়ে আসে। অপরাধ করে তারা আবার পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয়। তিনি সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা, চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা যাতে সহজে জামিন না পায়, সেটা বিবেচনার পরামর্শ দেন। রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার জিল্লুর রহমান বলেন, পুলিশের অনেক অস্ত্র খোয়া গেছে। এসব উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ৪৫৫টি পিস্তল এখনো বাইরে। ভারী অস্ত্রও আছে। এসব উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা করা হচ্ছে। অপরাধীদের ধরতে গেলে নানা তদবির আসে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলি গতকাল খুলনায় নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও পেশিশক্তির কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে না পারলে বহুল প্রত্যাশিত উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজন করা যাবে না। বিগত নির্বাচনগুলো নিয়ে মানুষের মাঝে ব্যাপক অসন্তোষ জমেছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে শক্তিশালী ও দক্ষ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা অপরিহার্য। 

উদ্ধার হয়নি ১৩৪০ আগ্নেয়াস্ত্র: গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের ৪৬০টি থানা ও ১১৪টি ফাঁড়ি ও গণভবনের দায়িত্বে থাকা এসএসএফের লুট হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভিন্ন ভিন্ন নামে একের পর এক অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। শেষতক গত ৫ই নভেম্বর এসব অস্ত্র উদ্ধার করলে সরকার বড় অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করে। পুরস্কার ঘোষণা করে একটি অস্ত্রও উদ্ধার করতে পারেনি সরকার। গত ৫ই নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পুলিশের লুণ্ঠিত বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে উৎসাহ দিতে আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এলএমজির (লাইট মেশিন গান) সন্ধানদাতাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা, এসএমজি (সাবমেশিন গান) দেড় লাখ টাকা, চায়না রাইফেল এক লাখ টাকা এবং পিস্তল ও শটগানের জন্য ৫০ হাজার টাকা দেয়া হবে। পাশাপাশি প্রতিটি গুলির জন্য পৃথকভাবে পুরস্কার ধরা হয়েছে ৫০০ টাকা। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। মিলেনি কোনো সুখবর। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর ৫ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছিল। এরমধ্যে ১ হাজার ৩৪০টি এখনো উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮টি গোলাবারুদের মধ্যে উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৮০টি।  লুট হওয়া ১ হাজার ১১৪টি রাইফেলের (চায়না) ১১৩টি উদ্ধার হয়নি। রাইফেল-টি ০৮ (বিডি) ১২টি থেকে ১টি উদ্ধার হয়নি। এসএমজি-টি ৫৬ (চায়না) ২৫৩ থেকে ৩১টি উদ্ধার হয়নি। এলএমজি-টি ৫৬ (চায়না) ৩৮টি থেকে ৩টি উদ্ধার হয়নি। পিস্তল-টি ৫৪ (চায়না) ৫৩৯টি থেকে ২০৭টি উদ্ধার হয়নি। পিস্তল ১ হাজার ৯২ থেকে ৪৫৫টি উদ্ধার হয়নি। এসএমজি/এসএমটি ৩৩টি থেকে একটিও উদ্ধার হয়নি। ১২ বোর শটগান ২ হাজার ৭৯ থেকে ৩৯২টি উদ্ধার হয়নি। গ্যাস গান (সিঙ্গেল শট) ৫৮৯টি থেকে ১২৯টি উদ্ধার হয়নি। টিয়ার গ্যাস লাঞ্চার (সিক্স শট) ১৫টি থেকে ৭টি উদ্ধার হয়নি। সিগন্যাল পিস্তল ৩টি থেকে ২টি উদ্ধার হয়নি। গোলাবারুদের মধ্যে বিভিন্ন বোরের গুলি ৬ লাখ ১৩ হাজার ১৫৮টি থেকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৭টি উদ্ধার হয়নি। বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস সেল ৩১ হাজার ২১২টি থেকে ১১ হাজার ৩৯১টি উদ্ধার হয়নি। বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস গ্রেনেড ১ হাজার ৪৮৬টি থেকে ২৯১টি উদ্ধার হয়নি। সাউন্ড গ্রেনেড ৪ হাজার ৭৪৬টি থেকে ১ হাজার ১৬৮টি উদ্ধার হয়নি। কালার স্মোক গ্রেনেড ২৭৩টি থেকে ৪১টি উদ্ধার হয়নি। সেভেন/মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৫৫টি থেকে ২২টি উদ্ধার হয়নি। ফ্ল্যাশ ব্যাং/৬ ব্যাং গ্রেনেড ৯০০টি থেকে ২২টি উদ্ধার হয়নি। হ্যান্ড হেন্ড টিয়ারগ্যাস স্প্রে (ক্যানিস্টার) ১৭৮টি থেকে ১১৬টি এখনো উদ্ধার করতে পরেনি পুলিশ। 

৭২০ জেল পলাতক আসামি অধরা: ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া সাত শতাধিক আসামি ১৬ মাস পরও অধরা। এদেরকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জালে। হত্যা মামলা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এসব আসামি দীর্ঘ সময় ধরে পলাতক থাকায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তা হুমকি। কারা ও পুলিশ সূত্র জানায়, পালিয়ে যাওয়া এসব আসামির মধ্যে হত্যা, সন্ত্রাস, ডাকাতি ও জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্ট গুরুতর মামলার অভিযুক্তরাও রয়েছে। পালানোর পর অনেককে গ্রেপ্তার করা হলেও বড় একটি অংশ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। নির্বাচন সামনে রেখে এসব পলাতক আসামি সহিংসতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন বা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে ভোটারদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারাসূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ৫ই আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে-পরে দেশের কয়েকটি কারাগারে বন্দিরা বিশৃঙ্খলা করেন। এ সময় দেশের পাঁচ কারাগারে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ করে ২ হাজার ২৪০ বন্দি পালিয়ে যান। হামলাকারীরা কারাগার থেকে ৯৪টি শর্টগান ও চায়নিজ রাইফেল লুট করেন। এর মধ্যে এক হাজার ৫২০ বন্দিকে কারাগারগুলোতে বিভিন্নভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ফিরিয়ে আনাদের মধ্যে জামিন হয়েছে এক হাজার ১৩০ জনের। এখনো প্রায় ৭২০ বন্দি পলাতক।