Image description

আওয়ামী লীগের পলাতক কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের ৩০টি পাজেরো গাড়ি নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

দেড় বছর ধরে এসব বিলাসবহুল যানবাহন চট্টগ্রাম বন্দরের কার শেডে আটকে ছিল। কাস্টমস সূত্র জানায়, গাড়িগুলো নিলামে তোলা হলেও প্রত্যাশিত মূল্য না পাওয়ায় বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিপুল মূল্যের এসব গাড়ি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। এ অবস্থায় চলতি বছরের শুরু থেকেই সরকার পরিবহন পুলের মাধ্যমে গাড়িগুলো আমলাদের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। তবে এ ধরনের নজির না থাকা এবং আইনি জটিলতার কারণে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটে।

সব ধরনের আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা কাটিয়ে অবশেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গাড়িগুলো ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমোদনক্রমে গতকাল শুক্রবার সকালে গাড়িগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়।

কাস্টমস সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে সরকার গঠনের পরপরই এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যবহার করে পতিত সরকারের অন্তত ৪০ এমপি ও মন্ত্রী নামমাত্র টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করে। কিন্তু খালাস করার আগেই শুরু হয় কোটাবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন। আন্দোলনের মধ্যেও কয়েকটি গাড়ি খালাস করে নেয় পলাতক এমপিরা। বাকি ৩১টি গাড়ি আটকে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কার শেডে। সাড়ে তিন থেকে ছয় হাজার সিসির এসব গাড়ির বাজারমূল্য ১২ থেকে ১৬ কোটি টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে একটি গাড়ি আমদানিকারকের অনুকূলে বরাদ্দ পেতে আদালতে মামলা করা হয়েছে। বাকি ৩০টি গাড়ি নির্ধারিত সময়ে খালাস নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি কেউ।

বন্দরের আইন অনুযায়ী, যেকোনো আমদানি পণ্য জাহাজ থেকে নামার চারদিনের মধ্যে আমদানিকারক রাজস্ব পরিশোধসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলো শেষ করতে পারলে স্টোর রেন্ট ছাড়াই পণ্য ডেলিভারি নিতে পারবে। কিন্তু চারদিন পেরিয়ে গেলে পর্যায়ক্রমে স্টোররেন্ট বাড়বে। কিন্তু অবশ্যই ৩০ দিনের মধ্যে পণ্য বুঝে নিতে হবে। ৩০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি নিতে না পারলে বাই পেপার কাস্টমসে হস্তান্তর করবে নিলামের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে দেওয়ার জন্য।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে এমপি-মন্ত্রীদের নামে আনা এসব গাড়ি কাস্টমসকে হস্তান্তর করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর দাপ্তরিক কাজ শেষ করে ইতোমধ্যে গাড়িগুলো নিলামেও তুলেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। বাংলাদেশ ও জাপানের বাজার অনুযায়ী গাড়িগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয় ১২ থেকে ১৬ কোটি টাকা পর্যন্ত। নিলামে গাড়িগুলোর ভিত্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

কিন্তু নিলামে এসব গাড়ির দাম ওঠে মাত্র এক থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে। কাস্টমসের নিলাম সিন্ডিকেট কারসাজি করে পানির দামে গাড়িগুলো কিনে নেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করে। বিষয়টি বুঝে ফেলে সরকার। তাই নিলাম প্রক্রিয়ার বিপরীতে সরকারি কাজে লাগানোর পরিকল্পনা শুরু হয়। কিন্তু কাস্টমস আইনে কোনো পণ্য নিলামে বিক্রি না হলে বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তি করার বিধান থাকলেও সরাসরি সরকারি কাজে লাগানোর নজির নেই। তাই নতুন করে তৈরি হয় আইনি জটিলতা। গত আগস্টে আটকে থাকা গাড়িগুলো সরকারি পরিবহন পুলে হস্তান্তরের নির্দেশনা এলেও চার মাস ধরে চলে আইনগত দিক পর্যালোচনা। সব কাজ শেষ করে গত মঙ্গলবার থেকে গাড়িগুলো ঢাকায় নেওয়ার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। কার শেডের মধ্যেই ব্যাটারি এবং মোবিল পরিবর্তনসহ বেশ কিছু জরুরি মেরামত কাজ করা হয়। অবশেষে গতকাল ঢাকার উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা ছেড়ে যায় গাড়িগুলো।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ আল আমিন জানান, নিয়ম অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে গেলে দীর্ঘদিন পড়ে থেকে জাতীয় সম্পদ নষ্ট হতো। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুল্ককর ব্যতিরেকে গাড়িগুলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে আপাতত ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে কোনো আমদানিকারক যদি শতভাগ শুল্ককর পরিশোধ করে গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে চায় তিনি সেই সুযোগ পাবেন। তাই আপাতত বলা যায় গাড়িগুলো ফেলে রেখে নষ্ট না করে ব্যবহারের মাধ্যমে সচল রাখা হচ্ছে। এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান জানান, একটি সিন্ডিকেটের কাছে পুরো নিলাম প্রক্রিয়া জিম্মি রয়েছে। ওই সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ নিলামে অংশ নিলেও নানা অজুহাতে কাস্টমস তাদের অনুকূলে গাড়ি হস্তান্তর করে না। আর এই কারণেই প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কেউ নিলামে অংশ নেয় না। সিন্ডিকেটের প্রভাব কমাতে এমন উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে আরো ভালো হতো নিলাম প্রক্রিয়াকে সংস্কার করে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নিলামে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে সরকারও নিলামে অংশ নিয়ে গাড়িগুলো নিষ্পত্তি করলে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ রাজস্বও আয় হতো।