Image description

আওয়ামী আমলের অন্যতম বিতর্কিত ভোট ছিল ২০১৮ সালের আয়োজন। ‘ডামি নির্বাচন’খ্যাত ভোটাধিকার হরণের এ তৎপরতায় জড়িত ছিলেন বহু সরকারি কর্মকর্তাও। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাইদুল ইসলাম। আওয়ামী পরিবারের এই কর্মকর্তা নৌকার পক্ষে উঠান বৈঠক করেছেন। নির্বাচনি প্রচারে ব্যবহার করেছেন সরকারি গাড়ি। শুধু তা-ই নয়, খরচ করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এতে তার শাস্তি তো দূরের কথা, বরং পদোন্নতির মাধ্যমে ধাপে ধাপে হয়েছেন পুরস্কৃত।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে মাইদুল পাচ্ছেন সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব। এতে নির্বাচনে তার মাধ্যমে বড় অঘটনের আশঙ্কা করছে সচেতন ও তার বিষয়ে অবগত মহল। তবে পরিবারের আওয়ামী সংশ্লিষ্টতা থাকলেও নির্বাচনি প্রচারে অংশ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাইদুল।

জানা গেছে, মাইদুলের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাত্রখাতা গ্রামে। তার বাবা আইনুল হক মোল্লা চিলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি। বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদের কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ছাত্রাবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপ-মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

মাইদুলের ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম চিলমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি। গত বছরের ২ আগস্ট ছাত্র-জনতার মিছিলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে কমপক্ষে ২০ জনকে আহত করেন তিনি। পরে জুলাই হত্যাচেষ্টা মামলায় সাজেদুল গ্রেপ্তার হয়ে দেড় মাস পর জামিনে মুক্তি পান। আরেক ভাই জাহেদুল ইসলামও আওয়ামী লীগে বেশ প্রভাবশালী। চিলমারীতে চোরাই মোটরসাইকেল সিন্ডিকেট ও সীমান্তে মাদক কারবারে জড়িত থাকায় তিনি বর্তমানে পলাতক আছেন।

মাইদুলের বোন দিলশাদ হাসি যুব মহিলা লীগ ও আরেক বোন নুসায়ার আহমেদ নিশি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। একই বাড়িতে বসবাসরত বড় বোনের স্বামী জাহাঙ্গীর আলম রমনা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য। এই পরিবার এলাকায় প্রভাবশালী আওয়ামী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত বলে জানান প্রতিবেশী সেলিম মুক্তার ওয়াহিদুল।

মাইদুলের ঘনিষ্ঠজন ও নিকটাত্মীয়রা জানান, তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩৬তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় দিনাজপুরের কাহারোলে উপজেলা সহকারী ভূমি কর্মকর্তা বা এসি ল্যান্ড ছিলেন মাইদুল। ডামি ভোটের সময় তার কুড়িগ্রামের বাড়িতে ছিল নির্বাচনি ক্যাম্প। কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী) আসনের নৌকার প্রার্থী বিপ্লব হাসান পলাশের পক্ষে সেখান থেকে আশপাশের এলাকায় চলত প্রচার।

মাঝেমধ্যেই সরকারি গাড়ি নিয়ে বাড়ি যেতেন এসি ল্যান্ড মাইদুল। উঠান বৈঠকসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নৌকার পক্ষে চাইতেন ভোট। তাদের সার্বিক চেষ্টায় নৌকা নিয়ে পাস করেছিলেন পলাশ।

জুলাই বিপ্লবের পর কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন মাইদুল। প্রশাসনের অদৃশ্য ইশারায় তিনি পদোন্নতি পেয়ে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হন। বর্তমানে তিনি ঢাকার দোহারের ইউএনও হিসেবে কর্মরত। একইসঙ্গে এবারের নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসারও হয়েছেন ।

পাত্রখাতা গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, মাইদুলের গ্রামের বাড়িতে নৌকার প্রচার ক্যাম্প থাকায় সেখানে বহু মানুষের যাতায়াত ছিল। মাঝেমধ্যেই উঠান বৈঠক করে তিনি ভোট চান। নৌকায় ভোট দিলে তিনি এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব নেবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী পলাশ।

জেলা জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাত বলেন, মাইদুলের মতো প্রশাসনে যত কর্মকর্তা আছেন, বিশেষ করে যারা আওয়ামী ভুয়া নির্বাচন বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের বরখাস্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় তারা শহীদ শরীফ ওসমান হাদি হত্যার মতো আগামী নির্বাচনেও বড় অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে। তারাই সব আওয়ামী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করবে। এছাড়া তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েও বিতর্ক আছে।

মাইদুল তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং বিসিএসে চাকরি পান। তবে তার বাবা আইনুলের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার গল্প নিয়ে স্থানীয়দের সন্দেহ আছে। স্থানীয়রা বলেন, চরের মানুষ তাকে ডাকাত হিসেবে জানে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে এলাকা থেকে পালিয়ে যান, ফেরেন যুদ্ধের পর। এলাকায় এসে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন। আওয়ামী আমলে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ টু-শব্দটি করেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তার সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ বলেন, ‘আইনুল হক কোথায় যুদ্ধ করেছেন আমরা জানি না। একাত্তরের পর থেকে এখনো জানতে পারিনি।’

চিলমারী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারী সরকার বলেন, বিগত ১৭ বছরে এই পরিবারের মাধ্যমে চিলমারীর বহু নিরীহ মানুষ নির্যাতিত হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে তারা চরের মানুষের জমিও দখল করে নিয়েছে। পাত্রখাতা স্কুলের খেলার মাঠ ও রাস্তা দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেছে।

উপজেলার ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম বলেন, ইউএনও মাইদুল এলাকায় এসে নৌকার জন্য প্রচার চালিয়েছেন—এটা শত শত মানুষ দেখেছে। এটা লুকানোর কোনো সুযোগ নেই।

নৌকার পক্ষের এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পাত্রখাতার বাসিন্দা অটোচালক সেলিম। তিনি বলেন, ‘তিনি (মাইদুল) এলাকায় উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নৌকায় ভোট চান। আমার মোবাইল ফোনে বেশ কিছু ছবি ও ভিডিও ধারণ করি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর মাইদুলের ভাই সাজেদুলের চাপে তা ডিলেট করেছি।’

নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য গ্রামের লোকজনকে মাইদুল টাকাও দিয়েছেন বলে জানান পাত্রখাতা গ্রামের আজিবুর রহমান। তিনি বলেন, সেদিন মাইদুলের বাড়িতে নৌকার বৈঠকে উপস্থিত থাকায় তিনি আমাকে ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। এমনকি ভোটের আগের ১৫ দিনের নৌকার নির্বাচনি যাবতীয় খরচ মাইদুল দেন।

৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি দুলাল মিয়া বলেন, আওয়ামী আমলে মাইদুল ও তার পরিবার বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেন, মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন। নৌকায় ভোট চাওয়া এই ফ্যাসিস্টরা আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করলে তা কখনই সুষ্ঠু হবে না।

একই ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাইয়ুম বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম ৫ আগস্টের পর মাইদুল ওএসডি হয়েছেন। পরে শুনলাম তাকে প্রমোশন দিয়ে ইউএনও করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার।’

মাইদুলের নেতৃত্বাধীন এক বৈঠকে ভোটকেন্দ্রের এজেন্ট ও নারী প্রতিনিধি নিয়োগ পান একই এলাকার প্রবাসী মকবুলের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘মাইদুলের বাসার এক বৈঠকে নারীদের একত্রিত করার দায়িত্ব ছিল আমার। তবে সেদিন শুধু মাইদুল ও প্রার্থী পলাশ তাদের নিজের মোবাইল ফোনে ছবি এবং ভিডিও ধারণ করেন। অন্যদের ছবি তুলতে নিষেধ করা হয়েছিল।’

স্থানীয় মুদি দোকানি শাহ আলম ও সাহেরা খাতুন জানান, নির্বাচনের সময় তাদের দোকানের পাশেই সরকারি গাড়ি রেখে বাড়ি যেতেন মাইদুল। অন্যান্য সময়ও গাড়ি সেখানে রাখতেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও দোহারের ইউএনও মাইদুল বলেন, ‘নির্বাচনকালে আমি কাহারোলের এসি ল্যান্ড ছিলাম। সরকারি কর্মকর্তারা কখনো কি নির্বাচনে কারো পক্ষে প্রচার চালাতে পারেন? যারা এগুলো বলছেন, তারা মিথ্যা বলছেন। আমি কখনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা নৌকার পক্ষে কাজ করিনি। আমি ভালো কর্মকর্তা। আমার বিষয়ে আপনারা খোঁজ নিতে পারেন। আমার বিরুদ্ধে কোনো ডকুমেন্ট আপনারা খুঁজে পাবেন না।’

সরাসরি নৌকার পক্ষে কাজ করা সরকারি কর্মকর্তার আসন্ন নির্বাচনে দায়িত্ব পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, দলীয় কর্মী হিসেবে যিনি নৌকার ক্যাম্পেইন করে বিগত সরকারের কাছে অনুকম্পা লাভ করেছেন, জেলা-উপজেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব তাদের হাতে থাকা মানে নিশ্চিত কোনো অঘটন টেনে আনা। নির্বাচন কমিশনের উচিত অতি দ্রুত এসব বিতর্কিত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া।