Image description

আওয়ামী দুঃশাসনের দেড় দশক ভোট দিতে পারেননি দিনাজপুরবাসী। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তরাঞ্চলের এই সীমান্তবর্তী জেলায় বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। জমজমাট প্রচারে জাগরণ তৈরি হয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে। তবে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর অন্তর্কোন্দল, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও ধানের শীষের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে অব্যাহত আন্দোলনের কারণে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে দলটি। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

জেলার ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত ছয়টি আসনের মধ্যে দুটি বাদে সব আসনেই জটিলতা আছে। এমনকি মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের মধ্য থেকে বিদ্রোহ করার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। অপরদিকে সুশৃঙ্খল নেতাকর্মী নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা সংঘবদ্ধ প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। দলটির নেতাকর্মীরাও বেশ উচ্ছ্বসিত।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন পর্যন্ত দুটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। আর ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ছয়টি আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এছাড়া গণঅধিকার পরিষদ চারটিতে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। এর মধ্য দিয়ে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে দীর্ঘ ১৭ বছর পর ভোটের ভিন্ন আমেজ বিরাজ করছে। শুধু বিরোধ ও অসন্তোষ দেখা

দিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের একাংশের মধ্যে। বিশেষ করে যারা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন তাদের অনুসারীরা বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না।

দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ ও কাহারোল)

আসনটিতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি জিতেছিল। আর কখনো দলটির কেউ জয় পায়নি। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিল জামায়াত। এবার উপজেলা বিএনপির সভাপতি মনজুরুল ইসলামকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। তার বিপরীতে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের মজলিসে শূরা সদস্য ও ইসলামী ছাত্রশিবির দিনাজপুর শহর শাখার সাবেক সভাপতি মতিউর রহমানের হাতে দাঁড়িপাল্লা তুলে দেওয়া হয়েছে।

ঐতিহ্য ধরে রাখতে জয় পাওয়ার আশায় নানা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে রাতদিন এক করে ফেলছেন জামায়াত নেতাকর্মীরা। আর বিএনপির একাংশের নেতাকর্মী নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন ধানের শীষের প্রার্থী। অপরদিকে তার মনোনয়ন বাতিল চেয়ে মশাল ও বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে সরব আছেন মনোনয়ন বঞ্চিত উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ধলু।

এখানে ইসলামী আন্দোলনের চান মিঞা, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জেলা শাখার সিনিয়র সহসভাপতি মোশাররফ হোসাইন, জেলা বাসদের সদস্য শ্রমিক নেতা আবদুল্লাহ আল মুনীর, গণঅধিকার পরিষদের জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সাধারণ সম্পাদক রিজওয়ানুল ইসলাম সজীবকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

দিনাজপুর-২ (বিরল ও বোচাগঞ্জ)

এ আসনে জেলা বিএনপির সদস্য সাদিক রিয়াজ চৌধুরীকে (পিনাক) মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তাকে মনোনয়ন দেওয়ার পর দলের একাংশের মধ্যে বিরোধ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আসনটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ কালু ও জেলা বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শিক্ষক নেতা অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম। আসনটিতে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মানববন্ধন, কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন এই তিন মনোনয়ন প্রত্যাশীর সমর্থকরা।

জামায়াত আসনটিতে প্রথমবারের মতো প্রার্থী দিয়েছে। দলটির জেলা শাখার কর্মপরিষদ সদস্য ও বিরল উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মাওলানা আফজালুল আনামের হাতে দাঁড়িপাল্লা তুলে দেওয়া হয়েছে।

এখানে ইসলামী আন্দোলনের জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রেদওয়ানুল কারীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা জোবায়ের সাঈদ, গণঅধিকার পরিষদের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক গোলাম আজম প্রার্থী হয়েছেন।

দিনাজপুর-৩ (সদর)

এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন দলটির অর্ধডজনের বেশি নেতা। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রার্থী ঘোষণা করায় সবাই এক হয়ে আনুষ্ঠানিক প্রচারে নেমেছেন। খালেদা জিয়ার পৈতৃক নিবাস হওয়ায় আসনটি ‘বিএনপির ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনে টানা তিনবার বিজয়ী হয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বড় বোন সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী প্রয়াত খুরশীদ জাহান হক চকলেট।

জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন বলেন, দলের চেয়ারপারসনকে প্রার্থী করায় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ ও আনন্দিত। তার জয় নিশ্চিত করতে সবাই নানাভাবে প্রচার চালাচ্ছেন।

জামায়াত জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই প্রচার চালাচ্ছে। এ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে জেলা জামায়াতের ইউনিট সদস্য মাঈনুল আলমকে। এছাড়া এনসিপির শামসুল মুকতাদির, ইসলামী আন্দোলন জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুফতি মুহাম্মদ খায়রুজ্জামান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেলা শাখার সভাপতি হাফেজ মাওলানা রেজাউল করিমকে প্রার্থী করা হয়েছে।

দিনাজপুর-৪ (খানসামা ও চিরিরবন্দর)

এ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান মিয়া মনোনয়ন পেয়েছেন। বিগত দেড় দশক নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন তিনি। তবে এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন খানসামা উপজেলা বিএনপির নেতা কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান ও এবং জেলা বিএনপি সাবেক সভাপতি ও জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি আবদুল হালিম। তারা ধানের শীষের নমিনি পরিবর্তন দাবিতে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন।

জামায়াত এখানে জেলা শাখার সাবেক আমির ও চিরিরবন্দর উপজেলা পরিষদের দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দীন মোল্লাকে প্রার্থী করেছে। অনেক আগ থেকেই প্রচার চালিয়ে মাঠ গরম করেছেন তিনি।

এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আনোয়ার হোসেন নদভী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চিরিরবন্দর উপজেলা শাখার সভাপতি মুফতি ফয়জুল্লাহ বুলবুলকে প্রার্থী করা হয়েছে।

দিনাজপুর-৫ (ফুলবাড়ী ও পার্বতীপুর)

এখানে গত আট সংসদে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রয়াত মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপি ছিলেন। এবার দলটির সব নেতা পলাতক থাকায় আসনটি দখলে মরিয়া বিএনপি ও জামায়াত। এ আসনে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও গত ৪ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ-সভাপতি মো. কামরুজ্জামানকে ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণা করায় বিক্ষুব্ধ হয়েছেন বঞ্চিতরা। তারা এই মনোনয়ন বাতিল দাবিতে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করছেন। এমনকি অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিও ডাকা হয়।

এখানে মনোনয়ন পাওয়ার আশা জিইয়ে রেখেছেন পার্বতীপুর উপজেলা বিএনপির কৃষিবিষয়ক সহসম্পাদক জাকারিয়া বাচ্চু ও পার্বতীপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেজোয়ানুল হক। তারা মনোনয়ন পরিবর্তন দাবিতে নিয়মিত আন্দোলন করছেন।

জামায়াত এখানে অনেক আগেই জেলা শাখার কর্মপরিষদের সদস্য আনোয়ার হোসেনকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলটির নেতাকর্মীদের দাবি, সারা দেশের মতো দিনাজপুরেও দাঁড়িপাল্লার পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। ভোটারদের মুখে এক কথা, এতদিন অন্যদের দেখেছি, এবার জামায়াতকে দেখব।

এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ডা. আবদুল আহাদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি এলাকায় গণসংযোগ, বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের শাহ মো. আবু সায়েম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস পার্বতীপুর উপজেলা শাখার সিনিয়র সহসভাপতি হাফেজ মাওলানা আবদুল কাদের, গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য শাহাজাহান চৌধুরীকে প্রার্থী করা হয়েছে। তারা সবাই প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর-নবাবগঞ্জ-ঘোড়াঘাট ও হাকিমপুর)

আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ হোসেন। হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে তিনি গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ, ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প, উঠান বৈঠকসহ এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। দলটির নেতাকর্মীরা মনে করছেন, এবারই প্রথম বিএনপি প্রার্থী দিলেও জনগণ তাদের বিপুল ভোটে জয়ী করবে।

জামায়াতের জেলা শাখার সাবেক আমির ও বর্তমান কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য আনোয়ারুল ইসলামকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি এলাকায় ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এখানে জয় পেয়েছিল জামায়াত। তাই দলটির নেতাকর্মীদের আশা, ভোটাররা এবারও বিপুলভোটে দাঁড়িপাল্লাকে বিজয়ী করবে।

এছাড়া আসনটিতে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হক, ইসলামী আন্দোলন দিনাজপুর (দক্ষিণ) শাখার সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিক, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জেলা শাখার সহসভাপতি মুফতি নুরুল করিম, গণঅধিকার পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি বুলবুল আহমেদকে প্রার্থী করা হয়েছে।

জেলা শহরের বাসিন্দা গোলাম মাওলা, মো. শামিম, আবদুল আলিম, সোহাগ, সদর উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্বাস আলী, বিরল উপজেলা চককাঞ্চন এলাকার বাসিন্দা সবুজ মিয়া, রহিত আলী, রবিউল ইসলাম, চিরিরবন্দর উপজেলার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলমসহ অন্তত ২০ ভোটারের কাছে এবার কাকে ভোট দেবেন জানতে চাইলে তাদের মধ্যে তিন-চারজন ছাড়া সবাই বলেন, ‘আমরা এর আগে সব দলকে দেখেছি। এবার নতুন কাউকে দেখতে চাই।’