বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন, রাজনীতিতে তারা প্রভাব রাখতে পারেন না। সরকারের নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক নয় বলে মনে করেন ৭৫ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে, ৭৩ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন, সরকারের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই।
বিবিএস পরিচালিত ‘নাগরিক ধারণা’ জরিপে এমন ফলাফল এসেছে। জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে গতকাল বুধবার প্রকাশ করা হয়। গত জুনে বিবিএস জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জরিপের তথ্য নেওয়া হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারি মাসে।
নাগরিকদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার ও বৈষম্য– ছয়টি লক্ষ্যের অগ্রগতি মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৬তম লক্ষ্যের অংশ। এতে দেশের ৬৪ জেলার ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানা থেকে ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ৮৪ হাজার ৮০৭ নারী-পুরুষ জরিপে অংশ নেন।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপের এক বছর আগে সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নাম এসেছে। নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ সন্ধ্যার পর নিজ বাসার আশপাশের এলাকায় একা চলাফেরায় নিরাপদ বোধ করেন। বাকি ১৫ শতাংশ এ ক্ষেত্রে অনিরাপদ বোধ করেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এস এম শাকিল আখতার এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী। বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রকল্পের পরিচালক রাশেদ-ই-মাসতাহাব। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বিবিএসের এসডিজি সেলের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন।
রাজনীতি ও সরকারের কর্মকাণ্ডে মানুষের প্রভাব কেমন
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র ২১ দশমিক ৯৯ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন, রাজনীতে তারা প্রভাব রাখতে পারছেন। বাকি ৭৮ শতাংশই মনে করেন রাজনীতিতে কোনো রকম প্রভাব রাখতে পারছেন না। এখানে গ্রাম এবং শহরের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। দুই জায়গায়ই এ হার সমান। তবে যারা প্রভাব রাখতে পারছেন, তাদের মধ্যে পুরুষের হার ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। নারীর হার ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ।
সরকারের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারেন বলে মনে করেন ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ মানুষ। বাকি ৭২ দশমিক ৭৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তারা মতপ্রকাশ করতে পারেন না। এখানেই গ্রাম শহর ফারাক সামান্যই। অন্যদিকে, ২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সরকারের নীতি সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং তাদের মতামতকে আমলে নেওয়া হয়। বাকিরা তা মনে করেন না। এখানেও নারী-পুরুষ ফারাক নেই। গ্রাম-শহর ফারাকটাও একই রকম।
বিআরটিএ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত
জরিপ অনুযায়ী, সরকারি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ। ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ মানুষ বলেছেন, বিআরটিএর সেবা নিতে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষের বিবেচনায় দ্বিতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে নাম এসেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ মানুষ এই ধারণা দিয়েছেন। দুর্নীতিতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে পাসপোর্ট অফিস, যা মনে করেন ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। ভূমি নিবন্ধন অফিসে ঘুষ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। বিচারপতি, ম্যাজিস্ট্রেট ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ঘুষ দেওয়ার কথা বলেছেন ৫৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এ ছাড়া ভূমি জরিপ অফিসকে ঘুষ দেওয়ার কথা বলেছেন ৫১ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ। ঘুষের লেনদেন হয়েছে টাকায়। ৯৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ মানুষ ঘুষ হিসেবে টাকা দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।
নোয়াখালীতে ঘুষের কারবার বেশি
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দেওয়ার প্রবণতায় শীর্ষে রয়েছে নোয়াখালী। এই জেলায় সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগকারী নাগরিকদের ৫৭ দশমিক ১৭ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কুমিল্লায় ৫৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কথা বলেছেন। তৃতীয় ফরিদপুরে ৫১ দশমিক ৭০ শতাংশ। কম ঘুষ দেওয়া জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ওপরে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। জেলায় ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ মানুষ সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এ তালিকায় দ্বিতীয় মাগুরা জেলায় ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ ও লালমনিরহাটে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ তাদের ঘুষ দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। সরকারি সেবা পেতে জাতীয়ভাবে গড়ে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ ঘুষ দেওয়ার কথা বলেছেন।
এই চিত্র জাতীয় উদ্বেগের বিষয়
আলোচনায় সরকারি সেবা পেতে ঘুষ, দুর্নীতির চিত্রকে জাতীয় উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন বক্তারা। পরিকল্পনা সচিব বলেন, ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে এই জরিপ সমাজের সঠিক চিত্র তুলে আনা হয়েছে। অনেক সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারী বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেন অথচ কাজ করেন না। এ বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে অবগত আছে। তিনি জানান, জনগণ নিরবচ্ছিন্ন সরকারি সেবা পাচ্ছেন কিনা, তা তদারকিতে একটি মনিটরিং ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করেছে সরকার। তবে অনেকের বাধায় তা করা সম্ভব হয়নি। এসব ব্যক্তি কোনো রকম জবাবদিহিতার আওতায় আসতে রাজি নয়।
বিবিএসের মহাপরিচালক বলেন, এ জরিপের ফলাফল থেকে বিভিন্ন সূচক নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। মতপ্রকাশ করতে ভয় পায় মানুষ। সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়। চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভালো ব্যবহারের অভাবের কারণে চিকিৎসা পেতে মানুষের মধ্যে বিদেশমুখী প্রবণতা রয়েছে। এসব কিছুই জাতীয় উদ্বেগের বিষয়।