নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড ঝুলিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে এসব পোস্টার-ব্যানার অপসারণে প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালালেও, জরিমানা ও সতর্কবার্তার পরও অনেক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা একই ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন নির্বাচনী শৃঙ্খলা প্রশ্নের মুখে পড়ছে, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ ও নগর সৌন্দর্য বিনষ্টের অভিযোগও উঠছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর ফেনী সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জসিম উদ্দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পোস্টার ও অন্যান্য প্রচারসামগ্রী অপসারণ না করায় ফেনী-২ (সদর) সংসদীয় আসনের বিএনপি, জামায়াত, এবি পার্টিসহ পাঁচ প্রার্থীকে মোট ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা পাওয়া প্রার্থীরা হলেন বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদীন ওরফে ভিপি জয়নাল, জামায়াতে ইসলামী মনোনীত দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য লিয়াকত আলী ভূঁইয়া, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি) মনোনীত ঈগল প্রতীকের প্রার্থী ও দলের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী ও জেলা সাধারণ সম্পাদক একরামুল হক ভূঁইয়া, জেএসডি মনোনীত তারা প্রতীকের প্রার্থী ও জেলা সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন মজুমদার। প্রত্যেক প্রার্থীকে ১০ হাজার টাকা করে মোট ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। প্রার্থীদের পক্ষে তাদের মনোনীত প্রতিনিধিরা জরিমানার অর্থ পরিশোধ করেন।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত আচরণবিধি অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী বা তার সমর্থক নির্বাচনী প্রচারণার জন্য পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, দেয়াল লিখন কিংবা সড়কের ওপর ঝুলন্ত বিজ্ঞাপন ব্যবহার করতে পারবেন না। ইসি জানিয়েছে, আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে তুলতেই এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। প্রার্থীরা কেবল নির্ধারিত সভা, সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ এবং ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে পারবেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহর, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রধান সড়ক, অলিগলি, বৈদ্যুতিক খুঁটি, দেয়াল ও সেতুর রেলিংয়ে এখনো বিভিন্ন প্রার্থীর পোস্টার ও ব্যানার ঝুলছে। অনেক ক্ষেত্রে রাতের আঁধারে এসব পোস্টার লাগানো হচ্ছে, যাতে প্রশাসনের নজর এড়ানো যায়।
প্রার্থীদের দাবি, পোস্টার-ব্যানার তাদের অজান্তেই সমর্থকরা লাগিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে নিজেদের পরিচিতি বাড়াতে সমর্থকরা অনেক সময় অতিরিক্ত উৎসাহে এসব কাজ করে ফেলেন। নিজে পোস্টার লাগানোর নির্দেশ তারা দেননি। কিন্তু সমর্থকরা হয়তো তাদের ভালোবাসা থেকে এসব করেছে।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, দেয়াল লিখন, বিলবোর্ড, গেট, তোরণ বা ঘের, প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জাসহ সব ধরনের প্রচারসামগ্রী এবং নির্বাচনী ক্যাম্প নিজ খরচে ও দায়িত্বে অপসারণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনার কথাও বলা হয়। তবে এগুলো এখন সর্বস্তরে সমানভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ইসিতে হট লাইনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছে। যেন কোনো আচরনবিধি লঙ্ঘন দেখলে সাধারণ ভোটার বা অন্য দলের প্রার্থীরা সংশ্লিষ্ট জায়গায় অভিযোগ করতে পারেন।
এছাড়াও নির্দেশনা না মানলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা ব্যবস্থা নেবেন। সেলক্ষ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালনে দেশের ১০টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ১০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইসির নির্দেশনা না মেনে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এতে ব্যক্তি বা প্রার্থীর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদ- অথবা সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা (অথবা উভয় দ-) হতে পারে। তবে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক দলের জরিমানা উল্লেখ করে বলা হয়, কোনো দল বিধি লঙ্ঘন করলে তাদেরও সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হতে পারে। প্রার্থীতার সর্বোচ্চ শাস্তি উল্লেখ করে বলা হয়, গুরুতর লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন চাইলে তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ব্যবহৃত সকল প্রকার নির্বাচনী প্রচারণাসামগ্রী অপসারণে কাজ করছে। গত ২ ডিসেম্বর ডিএসসিসি আওতাধীন এলাকায় অনুমতিবিহীন সকল ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড ও নির্বাচনী প্রচারপত্র ইত্যাদি স্ব উদ্যোগে অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট সংগঠন-ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ৮ ডিসেম্বর হতে সকল ওয়ার্ডের অনুমতিবিহীন সকল বিজ্ঞাপন ও নির্বাচনী প্রচারণাসামগ্রী অপসারণ শুরু করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার প্রায় সব ধরনের নির্বাচনী প্রচারসামগ্রী অপসারণ করা হয়েছে বলে বলছে তারা। একইসঙ্গে নতুন করে কেউ অননুমোদিত সামগ্রী লাগালে বা কোথাও পোস্টার-ব্যানার দেখা গেলে তা জানাতে হটলাইন নম্বর চালু করেছে সংস্থাটি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) গত নভেম্বর মাসে নগরজুড়ে মোট দুই লাখ ৪৭ হাজার অবৈধ ব্যানার- ফেস্টুন ও পোস্টার অপসারণ করেছে। ডিএনসিসি প্রশাসক বলেন, আমরা গত এক মাসে শুধু প্রধান সড়ক, রাজপথ এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে এ বিপুলসংখ্যক ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টার অপসারণ করেছি। বিভিন্ন গলিতে ব্যানার ফেস্টুনের পরিমাণ আরো বেশি। প্রধান সড়ক, রাজপথ এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে এ বিপুল সংখ্যক ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টার অপসারণ করা হয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, আমি নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে সমর্থন চাই। যদি সব জায়গায় অর্ডার প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি আমাদের পক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে না। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন আইন ও বিধির মাধ্যমে এবং তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, তারা ইলেক্টোরাল কমিটিকে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা দিয়েছেন। একই সঙ্গে ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটি এবং যে ম্যাজিস্টেরিয়াল টিম থাকবে তারা শুধুমাত্র পুলিশ নয়; যেকোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের কাছ থেকে তারা সাহায্য চাইতে পারবেন সেই প্রবিধানও আরপিওতে রয়েছে।
ঢাকা শহরে প্রার্থীদের পোস্টার ছড়িয়ে পড়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে সারাদেশের ডিসি-এসপি ও জেলা-আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আমরা দেখেছি ঢাকা শহর পোস্টারে ছেয়ে গেছে। কিন্তু আপনাদের তা সরানো দেখছি না। প্রতিটি কাজের পাবলিসিটি করেন। এখন যে পোস্টার সরে গেছে তা কিন্তু দেখছি না। ইসি এখন অভিযোগ দাখিলের দফতর হয়ে গেছে। মানুষকে জানাতে হবে কোথায় অভিযোগ করবে। অভিযোগ দায়েরের জন্য সেন্টার করতে হবে। আর ওই অভিযোগ সেন্টার থেকে অভিযোগ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিতে হবে।