আকাশপথে পণ্য আমদানি–রপ্তানি দ্রুততর ও ঝুঁকিমুক্ত করতে এয়ার কার্গো অপারেটর’স স্টেশন (এসিওএস) নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও আমদানি-রপ্তানিকারকেরা। একই সঙ্গে এসিওএস নীতিমালার আওতায় ‘অফ-ডক’ ব্যবস্থা চালু করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
ব্যবসায়ীদের মতে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং এর আশপাশে এ ধরনের সুবিধা থাকলে পণ্য খালাস দ্রুত হবে, খরচ কমবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য আরও গতিশীল হবে।
অফ-ডক হলো বিমানবন্দরের মূল সীমানার বাইরে নির্ধারিত এমন একটি স্থাপনা, যেখানে আমদানি–রপ্তানি পণ্যের খালাস, সংরক্ষণ, পরীক্ষা ও হ্যান্ডলিং করা হয়। সহজভাবে বললে, বন্দরের ভেতরে সব কাজ না করে বন্দরের বাইরে আলাদা স্থানে কার্গো কার্যক্রম সম্পন্ন করাই হলো অফ-ডক পদ্ধতি।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত ১৮ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রায় তিন দিন আকাশপথে আমদানি–রপ্তানি বন্ধ ছিল। এতে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকেরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এরপরই এয়ার কার্গো ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে এবং নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে অফ-ডক ব্যবস্থা চালুর দাবি জোরালো হয়।
গত ১৮ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রায় তিন দিন আকাশপথে আমদানি–রপ্তানি বন্ধ ছিল। এতে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকেরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এরপরই এয়ার কার্গো ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে এবং নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম নিশ্চিত করতে অফ-ডক ব্যবস্থা চালুর দাবি জোরালো হয়
এ বিষয়ে গত ১০ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ‘এয়ার এক্সপ্রেস সার্ভিস ডেলিভারি’ বিষয়ক একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, এয়ার কার্গো কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) ইতোমধ্যে ‘এয়ার কার্গো অপারেটরস স্টেশন (এসিওএস) স্থাপন, ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, তদারকি ও কাস্টমস নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২৫’-এর একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে।
আকাশপথে কেন দরকার অফ-ডক
ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে দীর্ঘদিন ধরে অফ-ডক ব্যবস্থা সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। একই আদলে ঢাকার বিমানবন্দরের আশপাশে এটি চালু করা গেলে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এককভাবে কার্গো হ্যান্ডলিং সেবা প্রদান করে। অফ-ডক চালু হলে বেসরকারি খাতে একাধিক অপারেটর আসবে, ফলে সেবার মান বাড়বে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি হবে।
তারা আরও জানান, বর্তমানে আকাশপথে পণ্য রপ্তানিতে বিমান বাংলাদেশ ও সিভিল এভিয়েশন প্রতি কেজিতে প্রায় ২৬ টাকা সার্ভিস চার্জ নেয়। অথচ একই সেবায় ব্যাংকক ৬.৪২ টাকা, কলকাতা ৪.৮৮ টাকা এবং দিল্লি ৬.১০ টাকা চার্জ নেয়। অফ-ডক ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশে পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেশি পড়ছে।
অফ-ডক ব্যবস্থা চালু হলে ইলেকট্রনিক কার্গো ট্র্যাকিং সিস্টেম (ইসিটিএস) চালু করা সম্ভব হবে। ফলে সহজে কার্গোর অবস্থান জানা যাবে এবং ওষুধের কাঁচামাল কিংবা জরুরি গার্মেন্টস স্যাম্পল দ্রুত পাঠানো সম্ভব হবে। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ত্বরান্বিত হবে। একই সঙ্গে ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা এর সুফল ভোগ করতে পারবেন।
বিশ্বের অনেক দেশে অফ-ডক ব্যবস্থা চালু আছে। সিঙ্গাপুর, দুবাই, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও জাপানের মতো উন্নত দেশে এই ব্যবস্থার ফলে পণ্য খালাসে জটিলতা নেই বললেই চলে।
ব্যবসায়ী নেতাদের বক্তব্য
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের মতো আকাশপথেও অফ-ডক ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তার মতে, ‘বর্তমানে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিং সেবা মূলত বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনস প্রদান করে। তবে, এ ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা খুবই সীমিত। অনেক সময় পণ্য খালাসে অতিরিক্ত দুই থেকে তিন দিন সময় লেগে যায়, যা রপ্তানি ও আমদানি—উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।’
‘অফ-ডক ব্যবস্থা চালু হলে এ ধরনের জটিলতা থাকবে না। এতে পণ্য খালাস দ্রুত হবে এবং সামগ্রিকভাবে আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য আরও সহজ ও গতিশীল হবে।’
বর্তমানে আকাশপথে পণ্য রপ্তানিতে বিমান বাংলাদেশ ও সিভিল এভিয়েশন প্রতি কেজিতে প্রায় ২৬ টাকা সার্ভিস চার্জ নেয়। অথচ একই সেবায় ব্যাংকক ৬.৪২ টাকা, কলকাতা ৪.৮৮ টাকা এবং দিল্লি ৬.১০ টাকা চার্জ নেয়। অফ-ডক ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশে পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেশি পড়ছে
‘অফ-ডক কোনো অজানা বা পরীক্ষামূলক ধারণা নয়। এটি দেশের জন্য নতুন পদ্ধতি হলেও বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে এই ব্যবস্থা চালু করে সফল হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশে এটি চালু করতে সমস্যা কোথায়’—প্রশ্ন রাখেন বিকেএমইএ সভাপতি।
এদিকে, গত ২৩ ডিসেম্বর এসিওএস নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনটি বলছে, ঢাকা বিমানবন্দর ও এর আশপাশে অফ-ডক সুবিধা চালু হলে আমদানি প্রক্রিয়া সহজ হবে এবং রপ্তানির গতি বাড়বে। তবে, এটি প্রদানে স্বল্প খরচে ভালো সেবা প্রদানে সুস্পষ্ট শর্ত থাকা প্রয়োজন।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। তাই অফ-ডক ব্যবস্থায় বিমানের সঙ্গে সমন্বয় এবং চুক্তির বিষয়টি নীতিমালায় স্পষ্ট থাকা জরুরি।
এ বিষয় জানতে চাইলে বিজিএমইএ পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘অফ-ডক ফ্যাসিলিটি অলরেডি চিটাগং পোর্টে আছে। যদি আকাশ পরিবহনে এই সুবিধা চালু করা যায় তাহলে দ্রুত সেবা পাওয়া যাবে।’
তার মতে, ‘অফ-ডক ব্যবস্থা চালু হলে ডিএইচএল বা ফেডেক্সের মতো কুরিয়ার কোম্পানিগুলো বন্ড লাইসেন্স নিয়ে সরাসরি ক্লিয়ারেন্স দিয়ে পণ্য ডেলিভারি করতে পারবে। এতে বিমানের ওপর নির্ভরতা কমবে এবং সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।’ এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আকাশপথে পণ্য আমদানি–রপ্তানি সহজ করতে দ্রুত এয়ার কার্গো অপারেটর’স স্টেশন নীতিমালা চূড়ান্ত এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘সকল অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে যত দ্রুত সম্ভব প্রস্তাবিত বিধিমালা চূড়ান্ত করে তা বাস্তবায়ন করতে চাই।’ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে বলেও জানান তিনি।