Image description

টানাপড়েন তিক্ততার স্তর পার হয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন উত্তেজনায়। উভয়প্রান্তে ঘটছে উত্তেজক নানা ঘটনা। যা স্পষ্টত পারস্পরিক অস্বস্তি বাড়াচ্ছে, বৈ প্রশমন হচ্ছে না। যার মধ্যে দূতকে সপ্তাহান্তে তলব, পাল্টা তলবের ঘটনা রয়েছে। এ অবস্থায় কূটনৈতিক অঙ্গনে যে প্রশ্নটি জোরালো হচ্ছে তা হলো- দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর মধ্যকার আচমকা এই উত্তেজনার শেষ কোথায়? পেশাদাররা বলছেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক মিশন ও পোস্টের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার বিষয়ে স্বাগতিক রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটা বাংলাদেশ, ভারত উভয়কে স্মরণ করাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যদিও দিল্লিতে গতকালও বিক্ষোভ হয়েছে। মিশন অভিমুখে চলা উগ্রপন্থিরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে কলকাতায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানীর বিক্ষোভ ফ্রন্টে ছিল রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকরা। মুম্বইতে বাংলাদেশ বিরোধিতায় এখন আর রাখঢাক নেই। মিশন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি রয়েছে। ময়মনসিংহে গুজব ছড়িয়ে হিন্দু যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ’ দাবি করে ভারত জুড়ে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। 

গত ২০শে ডিসেম্বর রাতে দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনারের বাসভবন বাংলাদেশ হাউজের একেবারে সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে উগ্রপন্থিরা। তারা দূতকে উদ্দেশ্য করে গালমন্দ করে এবং হুমকি দেয়। পূর্ব ঘোষণা এবং পুলিশি বাধা ছাড়াই চাণক্যপুরির নিশ্ছিদ্র এলাকার ওই নজিরবিহীন বিক্ষোভে মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং হাইকমিশনারের পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় দু’দিন আগে দিল্লি মিশনে ভিসাসহ সমুদয় কনস্যুলার সেবা নোটিশ করে বন্ধ করে দেয়া হয়। একই দিনে বন্ধ করে দেয়া হয় আগরতলার কনস্যুলার সেবাও। রোববার উগ্রপন্থিরা ভাঙচুর করে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশের ভিসা সেন্টার। যা ভারতীয়দের সেবার জন্য প্রাইভেট একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে চলছিল। সেই ভাঙচুরের ঘটনা এবং দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতকে হুমকির বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় দূতকে তলব করা হয় মঙ্গলবার। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত যোগাযোগ বন্ধ না হলেও উচ্চপর্যায়ের সফর ও যৌথ উদ্যোগে স্থবিরতা লক্ষণীয়। দুই প্রান্তেই সম্পর্ক শিথিল করার পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর চাপ রয়েছে। যদিও উভয় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা রয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হচ্ছে- বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভাঙনের দিকে না গেলেও এটি একটি স্পর্শকাতর পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং সেই আগুনে ঘি ঢালছে কিছু স্বার্থান্বেষী। 

দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ, ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ
ওদিকে ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাস হত্যার প্রতিবাদে মঙ্গলবার দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বড় ধরনের বিক্ষোভ করছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (বিএইচপি) এবং বজরঙ্গ দল। তারা বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হুমকি, ধর্মীয় স্থান ভাঙচুর ও অন্যান্য নিপীড়নের প্রতিবাদ জানায়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দিল্লি পুলিশ হাইকমিশনের বাইরে নিরাপত্তা জোরদার করে। নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও, প্রতিবাদকারীদেরকে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে কূটনৈতিক স্থাপনার দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেছে। প্রতিবাদকারীরা কমপক্ষে দু’টি বাধা অতিক্রম করে কূটনৈতিক ভবনের দিকে এগিয়ে যায়। সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। এনডিটিভি জানিয়েছে, পুলিশের সঙ্গে প্রতিবাদকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। প্রতিবাদকারীরা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার বহন করে দীপু চন্দ্র দাসের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি জানায়। একজন প্রতিবাদকারী বলেন, আজ আমরা আমাদের কণ্ঠস্বর না তুললে, আমি দীপু, আপনি দীপু হবো।


ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব
ভারত সরকারের কাছে গভীর উদ্বেগ জানাতে মঙ্গলবার বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। ২০শে ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের বেষ্টনীর বাইরে সংঘটিত অনাকাঙিক্ষত ঘটনাসমূহ এবং ২২শে ডিসেম্বর শিলিগুড়িতে বাংলাদেশ ভিসা সেন্টারে বিভিন্ন উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত ভাঙচুরের প্রেক্ষিতে এ সময় এই উদ্বেগ জানানো হয়। একই সঙ্গে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের সামনে সহিংস বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনায় বাংলাদেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ কূটনৈতিক স্থাপনাসমূহের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত সহিংসতা বা ভীতি প্রদর্শনের যেকোনো কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানায়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু কূটনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করে না, বরং পারস্পরিক সম্মান, শান্তি ও সহনশীলতার মূল্যবোধকেও ক্ষুণ্ন করে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ভারতের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, উল্লিখিত ঘটনাগুলোর বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করতে, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এবং ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন ও সংশ্লিষ্ট স্থাপনাসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার আশা করে আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার আলোকে ভারত সরকার অবিলম্বে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে কূটনৈতিক কর্মী ও কূটনৈতিক স্থাপনাসমূহের মর্যাদা ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকে।

কলকাতাতেও বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ, ভাঙলো ব্যারিকেড: 
নিজস্ব প্রতিনিধি কলকাতা থেকে জানান, দীপু দাস হত্যার প্রতিবাদে কলকাতাতে বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়েছে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্য ও সমর্থকরা। সোমবার তারা বিক্ষোভ করলেও মঙ্গলবার তারা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। একটি ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে পৌঁছে যায় বিক্ষোভকারীরা। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়ায় বিক্ষোভকারীরা। মুহূর্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তারপরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ধুন্ধুমার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গোটা এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। 
এদিন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, এভিবিপি, হিন্দু জাগরণ মঞ্চসহ সঙ্ঘ পরিবারের একাধিক সংগঠনের ডাকে বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস অভিযানে সমবেত হয়েছিলেন অনেকে। মিছিল করে তারা পৌঁছান বেকবাগান এলাকায়। তবে বাংলাদেশের উপ-দূতাবাসের সামনে পৌঁছানোর আগেই বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয় পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের তরফে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসে স্মারকলিপি দেয়া হবে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের আটকাতেই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বেকবাগান এলাকা। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। 
সোমবার শিলিগুড়ির বাংলাদেশ ভিসা সেন্টারের সামনেও হিন্দুত্ববাদীরা বিক্ষোভ দেখায়। ভিসা সেন্টার বন্ধের দাবি জানানো হয়। এরপরই সেই ভিসা সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়।
এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন অভিমুখে মিছিল করে বামপন্থি দলগুলোও। তবে মিছিল উপ-দূতাবসের দুইশ’ মিটার আগেই আটকিয়ে দেয় পুলিশ।
সিপিআই (এম), সিপিআই, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল বা এসএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক এই প্রতিবাদ অংশ নেয়।
তারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতনের প্রসঙ্গের সঙ্গেই সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ওপরে হামলার বিরোধিতা করেন।