Image description

সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার হওয়া সিনিয়র  সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংগঠনটি বলেছে, ‘মত প্রকাশের কারণে ব্যক্তিদের নিশানা করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করা উদ্বেগজনক প্রবণতার অংশ। বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) সংগঠনটির ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এমন দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘চলতি বছরের মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। সংশোধনের পর থেকে এই আইন ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ তালিকায় সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্নার নামও রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা দমনে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহারকে লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়।’’

এদিকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাংবাদিক আনিস আলমগীরের গ্রেফতার পরবর্তী পাঁচ দিনের রিমান্ডের ব্যাপারে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে দেশে-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন, সম্পাদক পরিষদ, পেন বাংলাদেশ, সিপিজে   ইতোমধ্যে  নিন্দা জানিয়েছে। তারা এটিকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার ওপর গুরুতর আঘাত, হয়রানি এবং রাষ্ট্রীয় দমন -পীড়ন

বলে অভিহিত করে অবিলম্বে আনিস আলমগীরের নিঃশর্ত মুক্তি ও হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছে। সংগঠনগুলো বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে আটকে রাখা এবং পরে মামলা দেওয়া অগ্রহণযোগ্য, যা অতীতের দমন-পীড়নকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

গত ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আনিস আলমগীরকে  সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড দেওয়া হয়। ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালত থেকে এ আদেশ দেন। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে শনিবার (২০ ডিসেম্বর) তাকে কারাগারে পাঠায় আদালত।

জুলাই রেভ্যুলেশনারি অ্যালায়েন্সের কেন্দ্রীয় সংগঠক আরিয়ান আহমেদ বাদী হয়ে  উত্তরা পশ্চিম থানায় আনিসের বিরুদ্ধে মামলা করেন।  মামলায় সাংবাদিক আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে টকশোতে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার অভিযোগ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘‘আনিস আলমগীরসহ অন্যরা ৫ আগস্টের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে বসে নিষিদ্ধ সংগঠনকে ফিরিয়ে আনার গুজব  চালিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পাঁয়তারা করছে। এসব বিভিন্ন পোস্টের ফলে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা অনুপ্রাণিত হয়। ফলে তারা রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অবকাঠামোকে ধ্বংস করছে।  রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে।’’

কিন্তু ওইদিন আদালতের শুনানিতে এসব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন সাংবাদিক আনিস আলমগীর। তিনি আদালতকে বলেছেন, তিনি একজন সাংবাদিক। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই তার কাজ। কোনও নির্দিষ্ট দলের হয়ে তিনি কথা বলেননি কখনও। আগের সরকারের আমলেও তিনি এভাবে কথা বলতেন। তিনি কোনও ষড়যন্ত্র বা দেশবিরোধী কিছুর সঙ্গে জড়িত নন। তার টকশো এবং স্ট্যাটাসকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে তাকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ফাঁসানো হচ্ছে।’’  আদালতকে আনিস আলমগীর বলেন, ‘‘আমি হালুয়া রুটির ভাগীদার নই।’’ সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘‘তারা আমাকে হয়তো নিজেদের অনুসারী বানাতে চায়, এজন্য  এমন প্রতিহিংসামূলক মামলা দিচ্ছে।’’

শুধু কি আনিস আলমগীর? জাতীয়  প্রেসক্লাবের পাঁচবারের সভাপতি সাংবাদিক শওকত মাহমুদও বর্তমানে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কারাগারে আছেন। তাকেও পাঁচ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। আনিস আলমগীরের ঘটনার ঠিক চারদিন আগে বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর)  রমনা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায়   ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যজিস্ট্রেট ফাহমিদা খন্দকার আন্নার আদালত শওকত মাহমুদকে রিমান্ডের আদেশ দেন। রিমান্ড শেষে তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়।

মামলায় শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। এজন্য  সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীর সঙ্গে মিলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন।

অভিযোগের ব্যাপারে আদালতে সাংবাদিক শওকত মাহমুদ বলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ এ সরকার আসার পরে আমার ৬০টি মামলা প্রত্যাহার করেছে। যে সরকার মামলা তুলে নিলো সে সরকারের বিরুদ্ধে কেনও ষড়যন্ত্র করবো? গ্রেফতারের পর পুলিশ আমার ফোন নিয়ে গেছে। রাষ্ট্রবিরোধী কিছুই পাবেনা  ফোনে, ইনশাআল্লাহ।’’ তিনি বলেন, ‘‘আমি চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছি, আদালতের কাছে ন্যায় বিচার চাই।’’ পরে শুনানি শেষে আদালত তার আইনজীবীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে রিমান্ডে পাঠান।

এছাড়া গত ৬ নভেম্বরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় দৈনিক কালবেলার উপজেলা প্রতিনিধি মেহেদী হাসান নামে এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।  গ্রেফতারের পর মেহেদীকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টুঙ্গিপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর। তার বিরুদ্ধেও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে  সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনা হয়। সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ ও তার মুক্তি দাবি করেছেন গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় জেল খেটে গত ১২ নভেম্বর  জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘এ সরকারের সময়  গত দেড় বছরে ৩৫৪ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যে মামলা, তা ইতিহাসে রেকর্ড। সুতরাং, ধরে নিতে হবে সাংবাদিকরা এ সরকারের অন্যতম টার্গেট। শুধু টার্গেট বললে ভুল হবে, অন্যতম মূল টার্গেট। আওয়ামী সরকারের সময়েও এভাবে সাংবাদিকদের আটকানোর ঘটনা ছিল— সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়ে। তখনও আমরা প্রতিবাদ করেছি। এ সরকারের সময়ও যেটা হচ্ছে, সে বিষয়ে মন্তব্য করা না করার কিছু নেই।’’

পান্না বলেন, ‘‘‘আনিস আলমগীর ভাইয়ের বিরুদ্ধে যে মামলা দেওয়া হয়েছে, আমাকেও সেই মামলা দেওয়া হয়েছে। দৃশ্যপট একই ধরনের বলা চলে। কারণ, তাকে ১৮ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে কোন মামলা দেওয়া হবে, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। আমাকেও প্রায় ১২ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে রাত  একটার সময়ে মামলা দেওয়া হয়েছিল। আনিস ভাইয়ের বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নিন্দা জানিয়েছে। আমার সময়েও হিউমান রাইটস ওয়াচসহ অনেকেই  নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল। সুতরাং, এগুলো সবাই জানে সবাই বুঝে যে, কী হচ্ছে। এখন সন্ত্রাসবিরোধী আইনের যে অপপ্রয়োগ করছে, তা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আরও একটা ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, যেটি আওয়ামী সরকারের সময়ও হয়নি। সেটি হচ্ছে, ব্রিটিশ সরকারের করা বড় একটি কালো আইন— ডিটেনশন (বিনা বিচারে আটকাদেশ) যেটি ব্রিটিশ সরকারের সময়ে দেওয়া হতো, যারা তাদের চোখে অপরাধী ছিল, সেসব মানুষকে। বর্তমান সরকার সেটি করছে, যা আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে দেওয়া হয়নি। এখন সেই ডিটেনশনটা  প্রয়োগ করা হচ্ছে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের ব্যাপারেও। যাদের বয়স ১৮ এর নিচে, তাদের বয়স বাড়িয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই ভয়ংকর। একটা ঘরের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা বন্দি করে রাখা। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ে আধঘণ্টার জন্য বের করা হয়। এটা যে কতবড় একটা নির্যাতন, যারা নিজ চোখে দেখেনি, তারা বিশ্বাস করতে পারবে না।’’

সন্ত্রাসবিরোধী আইনেই কেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে জানতে চাইলে মঞ্জুরুল আলম পান্না বলেন, ‘‘এতদিন হত্যা মামলা দিয়েছে, সেটা সমালোচিত হওয়ার পরে এখন সন্ত্রাসবরোধী আইন বেছে নিয়েছে।, আমি বা আনিস ভাই কি এই আইনের কোনও ধারায় পরি? ধারায় স্পষ্ট লেখা আছে, যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করছে বলে প্রমাণিত হবে, তাদের এ আইনের আওতায় শাস্তি হবে। কিন্তু আমরা কি এমন করেছি? সুতরাং, এখন এ আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। জামিনের ক্ষেত্রে বিচারকদের উদ্দেশ্যে সরকার বলেছে যে, যাকে- তাকে জামিন দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হতে পারে দুই-একটা ঘটনায়। কিন্তু ঢালাওভাবে এ আইনে গ্রেফতার কাউকে জামিন দেওয়া হবে না। এমনকি যখন জেলে ছিলাম, তখন পত্রিকায় পড়েছি— স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক কাউকে যেন সহজে জামিন না দেওয়া হয়। তাহলে এটা কিী? জামিন তো নাগরিকের মৌলিক অধিকার।’’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘সব সরকারের আমলেই সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমরা ৫ আগস্ট পরবর্তী সরকারের সময়ে ভাবছিলাম— এমন হুমকি আর থাকবে না। কিন্তু তা আর হলো না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনও বিভিন্নভাবে হরণ করা হচ্ছে। আগের সরকারের আমলে সাইবার অ্যাক্টে সাংবাদিকদের বাধাগ্রস্ত করা হতো। এ সরকারের আমলে হচ্ছে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে। এটা মোটেও আশা করিনি। সাংবাদিকদেরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে যে হয়রানি, এটি বর্তমান সময়কার জন্য অশনি সংকেত না শুধু— পরবর্তী যে সরকার আসবে, তাদের কাছেও এটি আতঙ্কের হয়ে থাকবে।’’

টিআইবি পরিচালক বলেন, ‘‘আমার মনে হচ্ছে, এ দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আর ফিরবে না।’’

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিভি) প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘এখন কমেন্ট কি করা যায় বাংলাদেশে?’’ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা মানবাধিকার লঙ্ঘন কিনা, জানতে চাইলে  তিনি  বলেন, ‘‘মানবাধিকার লঙ্ঘন সরাসরি না হলেও এটি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। কারণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার— যা মানবাধিকারেরই অংশ।  সেক্ষেত্রে বলা গেলেও আমাদের সংবিধানে যেহেতু এভাবে বলা নেই, সেক্ষেত্রে এটা এভাবে বলা যায় না। তবে সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। আর সাংবাদিকদের সেই মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে সরকার। সরকার চায়, সাংবাদিকরা কথা না বলুক। আসলে সাংবাদিকতা পেশাটাই হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে এমন ঝুঁকি থাকবেই।’’

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার প্রশ্নে এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘‘এ সরকারের এটা নতুন সংযোজন। বিগত সরকার সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়ে মামলা দিতো। সেটা এ সরকার সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু এখন তো নতুন একটা হাতিয়ার লাগবে তার। সেক্ষেত্রে সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কারণ, এখন যদি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ব্যবহার করে, তাহলে তো সবাই বলবে— কী পরিবর্তন হলো? এজন্য নতুন করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। তার মানে ব্যাপারটা এমন বোঝা যাচ্ছে যে, সাংবাদিকরা সন্ত্রাসী?’’

এ বিষয়ে জানতে আইন ও বিচার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খাদেম উল কায়েসকে ফোন করা হলে তিনি জানান, মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। পরে যোগাযোগ করতে বলেন। একদিন পর আবারও  ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা যায় কিনা এবং আইনটির ব্যাখ্যা সম্পর্ক জানতে আইন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি। তবে কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা বিএম তরিকুল কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমরা কাজ করি আইনের ভুল সংশোধন নিয়ে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কাউকে গ্রেফতারের বিষয়ে কোনও কমেন্ট করার সুযোগ আমার নেই। এগুলো আমার জব ডেসক্রিপশনের মধ্যে পরে না।’’

সাংবাদিকদেরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাংবাদিকদের  ফাঁসানো হচ্ছে ব্যাপারটা এমন না। এ আইনে মামলা হওয়ার জন্য যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে হবে, তাও না। কেউ সন্ত্রাস উসকে দিলেও এ আইনের আওতায় আসবে। সাংবাদিক আনিস আলমগীরের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। রাষ্ট্র পক্ষের এই পিপি বলেন, ‘‘উনি (আনিস আলমগীর)  যে বক্তব্য দিয়েছিলেন— প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ভাঙবে, গ্রামীণ ব্যাংক ভাঙবে, এতে করে তিনি সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে উৎসাহিত করেছেন।’’ এসব অভিযোগের বিষয়ে আনিস আলমগীর আদালতে জবাব দিয়েছেন। তার ভাষ্য, তিনি এগুলো কথার প্রেক্ষিতে বলেছেন উদাহরণ হিসেবে। তার উদ্দেশ্য উসকে দেওয়া না— বাংলা ট্রিবিউনের এমন প্রশ্নের জবাবে  পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘‘কথাগুলো তো তিনি সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার (বাসভবন গ্রামীণ ব্যাংক)… এভাবে উল্লেখ না করে  অন্যভাবে বলতে পারতেন। তাতো বলেননি। বলেছেন, উসকানিমূলকভাবেই। সুতরাং, তার বক্তব্যে সন্ত্রাসীদের উসকে দেওয়া হয়েছে বলেই মনে করি।’’

অন্যান্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলার বিষয়ে এ পিপি বলেন, ‘‘অবশ্যই এ আইন সাংবাদিকদের জন্য খাটানো হচ্ছে না। তবে সাংবাদিকদেরও কথার একটা সীমাবদ্ধতা থাকা দরকার, যা ইচ্ছে তাতো বলতে পারবেন না।’’

সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের নামে  সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাজনীন নাহার বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন তো জঙ্গি সন্ত্রাস দমনের জন্য। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংজ্ঞায় বলা আছে ‘যে সন্ত্রাস করবে তাকে এ মামলায় আসামি করা হবে।’ এখন আনিস আলমগীর কি সন্ত্রাস করেছেন? আমার প্রশ্ন হচ্ছে সেটা, উনি যদি সন্ত্রাস করে থাকেন, তাহলে হবে। এমনকি ওনার মামলার এজাহারে  কিন্তু এমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি।  উনি কোনও সন্ত্রাসকে উসকেও দেননি। যেটা হয়েছে, উনি এখানে উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন। ওনার টকশোটা আমি শুনেছি, উনি এখানে আসলে বলেছেন যে, তখন একদল লোককে ধানমন্ডি ( ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি) ভাঙার জন্য উসকে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে উসকে দেওয়ার ধারাবাহিকতা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় না থাকলেও আগামীতে অন্য কেউ উসকে দিতে পারে। আর এ ধারাবাহিকতা দেশকে অস্থিতিশীল করবে। উনি এটা বুঝাতে চেয়েছেন।’’

তিনি বলেন, ‘‘এখানে উনি (আনিস আলমগীর) তো উসকে দেননি। উনি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও উসকানি থেকে সরকারকে সতর্ক করেছেন।’’

সুতরাং, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তার বিরুদ্ধে কেন এ মামলা দেওয়া হয়েছে, আমার বোধগম্য নয়।’’

আরেক আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা বেমানান। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হতে পারে।’’ তিনি বলেন,  ‘‘এ মামলার শাস্তি বেশি (জামিন অযোগ্য)।  এজন্য হয়তো সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে এই মামলা দিচ্ছে সরকার।’’

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কী আছে

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ধারা ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৫ সালে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা, পরবর্তীকালে নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের বিস্তার ও অর্থায়ন রুখতে

‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ (২০০৯ সালের ১৬ নং আইন প্রণয়ন করা হয়। মূলত জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে দমনের লক্ষ্যেই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০০৮ সালের অধ্যাদেশটিকে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থায়ী আইনে রূপ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ গেজেট ও লেজিসলেটিভ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এই আইনে (যা ২০১২ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত) সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটানোর দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

জাতীয় সংসদ সচিবালয় ও সংশোধনী আইন সূত্রে জানা যায়,  ২০১৩ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য ও ডিজিটাল প্রমাণাদি ও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। আইনের সংজ্ঞা মোতাবেক, রাষ্ট্রকে চাপে ফেলা বা জনমনে ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশে কোনও হামলা বা বিস্ফোরকের ব্যবহার সন্ত্রাসীবাদী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।  এছাড়া এ আইনের ১৮ ধারা অনুযায়ী, সরকার যেকোনও সংগঠনকে সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিষিদ্ধ করতে পারে এবং ৪০ ধারা মোতাবেক এসব অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য। বর্তমানে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এই আইনের অধীনে হওয়া মামলাগুলোর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা হচ্ছে।