Image description

নির্বাচনী ট্রেন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। দেশের জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনীতির গতি সচল ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় নির্বাচন অপরিহার্য। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই ‘১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব’ মন্তব্য করেছিলেন। এখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেনাবাহিনী জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। নির্বাচনের পর সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে। নির্বাচন কমিশন ভোটের প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে চালাচ্ছে; প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাই, ঘোষণা এবং জোট ও ফ্রন্টভুক্ত দলগুলো নিজেদের মধ্যে আসন ভাগাভাগিতে মহাব্যস্ত। সারা দেশে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে এবং ভোটাররা ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের ঘোষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানের পরও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেনÑ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কী পর্দার আড়ালে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা হচ্ছে? ভারত-বিরোধিতার নামে দিল্লির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের নেপথ্যের রহস্য কি? নির্বাচন কী ঘোষিত তারিখে হবে?

ভারতকে নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করায় ভোট দেয়ার লক্ষ্যে মুখিয়ে থাকা অনেকেই বলছেন, নির্বাচন ইস্যুতে রাজনীতির ভেতরে কী পলিটিক্স ঢুকে গেল? দেড় বছর ধরে হিন্দুত্ববাদী ভারতের সাথে বাংলাদেশের ‘শীতল সম্পর্ক’ বিরাজমান। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান হাদিকে পৈশাচিকভাবে হত্যাচেষ্টা, অপ্রাসঙ্গিভাবে সেভেন সিস্টার্স ইস্যু সামনে এনে দিল্লিকে ক্ষেপিয়ে তোলা, ঢাকাস্থ ভারতের দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দিয়ে ইট খুলে ফেলার হুমকি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি প্রচারণার লক্ষ্যে সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থীর নিরাপত্তা চেয়ে নির্বাচন কশিমনে আবেদনÑ এসব কী নির্বাচন পেছানোর চেষ্টায় রাজনীতির ভেতরে ষড়যন্ত্র ‘পলিটিক্স’। ‘পলিটিক্সের ‘পলি’ অর্থ-বহুমুখী, আর ‘ট্রিকস’ মানে কারসাজি; পলিটিক্স অর্থÑ বহুমুখী কারসাজি। হিংসা-বিদ্বেষের রাজনীতিতে ‘পলিটিক্স’ শব্দটি আর এককভাবে ‘রাজনীতি’ অর্থ বহন করছে না। গণতন্ত্রের জনক হিসেবে পরিচিত অ্যারিস্টটল ‘পলিটিক্স’ অর্থ সৎ রাজনীতি হলেও ম্যাকিয়াভেলির থিউরিতে রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য রাজনীতির নামে পলিটিক্সকে অপকৌশল, ধূর্ততা, নোঙরামি, ষড়যন্ত্র আর কপটতাকে বোঝানো হয়েছে। ভারত-বিরোধিতার নামে ভারতের হাতে ইস্যু তুলে দেয়ার নেপথ্যের রহস্য কি? কেনই বা ভারত-বিরোধিতার নামে হাসিনার হুঙ্কার ‘নো আওয়ামী লীগ, নো ইলেকশন’ পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে?

ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তুতি এবং দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করেছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সশস্ত্রবাহিনীসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সদা সতর্ক ও সচেষ্ট রয়েছে। ঢাকার বিদেশি দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা দেয়া হবে। নির্বাচন কমিশন বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাবে, এ ব্যাপারে সব তথ্য বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করে নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। নির্বাচন বানচালের লক্ষ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে কিছু আওয়ামী লীগের ডেভিল। তারা গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেইজ-২’ শুরু করেছে। নির্বাচনের পরিবেশ স্বাভাবিক। সব রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানতে সভা-সেমিনার, উঠান বৈঠক করছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ১৭ বছরের প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরবেন। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় এই নেতার দেশে ফেরার সময় একটি গোষ্ঠী ভারত-বিরোধিতার নামে উত্তেজনা তৈরির টার্গেট করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ ভারত-বিরোধিতার নামে দিল্লিকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূলে নয়Ñ এমন পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যেই কী পরিকল্পিতভাবে ভারত-বিরোধিতার ডামি আন্দোলন চলছে? সেভেন সিস্টার্স পৃথক করার হুঙ্কার দিয়ে ভারতের হাতে ‘বাংলাদেশে উগ্রবাদী আছে’ কার্ড তুলে দেয়া হচ্ছে। হঠাৎ করে সেভেন সিস্টার্স ভারত থেকে পৃথক করে দেয়া এনসিপির হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য এবং কয়েক জন সম্ভাব্য প্রার্থীর নিরাপত্তা চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন কী ম্যাকিয়াভেলির রাজনীতির ভেতরে পলিটিক্সের থিউরি!

হিন্দুত্ববাদী ভারত দ-প্রাপ্ত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কয়েক শ’ নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। দিল্লিতে বসে হাসিনা বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন; হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। বাংলাদেশ কূটনৈতিক চ্যানেলে সে সব বন্ধের দাবি জানিয়েছে। ওসমান হাদির হত্যা চেষ্টার শুটারকে আশ্রয় যাতে না দেয়া হয় সে প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের মুসলিম-বিদ্বেষী বিজেপি সরকারের কর্মকা-ে চরম বিক্ষুব্ধ। কিন্তু বর্তমান নির্বাচনকালীন সময়ে সেই ভারত-বিরোধিতার নামে ভারতকে উসকানি দিয়ে দিল্লির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা হচ্ছে কেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেছেন, হিন্দুত্ববাদী ভারত উগ্রবাদীদের প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ভারত-বিরোধিতার নামে ভারতের অভিযোগ সত্য প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে। যারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবে না এবং নির্বাচন ছাড়াই এখন প্রশাসন থেকে সুবিধা নিচ্ছে তারাই নির্বাচন পেছানোর লক্ষ্যে ভারত-বিরোধিতার খেলা খেলছে। মূলত আওয়ামী লীগ যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নানা কা- করত; মুক্তিযুদ্ধের অজুহাতে সুবিধা নিত; এখন জুলাই চেতনার নামেও তেমন চলছে। জুলাই চেতনার নামে ‘মব’ সন্ত্রাসের চেষ্টা হচ্ছে, প্রশাসনে সুবিধা নেয়া হচ্ছে, হাদির হত্যাচেষ্টা-বিরোধিতার নামে ঢাকাস্থ ভারতের হাইকমিশন অফিসের ইট খুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। এ সবের নেপথ্যে রয়েছেন নির্বাচন হলে যারা বিজয়ী হতে পারবে না এমন রাজনৈতিক শক্তির ইন্ধন। ভারত-বিরোধিতার নামে এখন তারা নির্বাচন ঠেকাতে ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হোক, নির্বাচন না হোক’ দিল্লির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।

ভারতের সহায়তায় ২০১৪ সালে প্রার্থী ও ভোটারবিহীন, ২০১৮ সালে রাতের ভোট ও ২০২৪ সালে আমি-ডামি নির্বাচনের প্রহসন হয়েছে। দেশের মানুষ প্রায় বহু বছর ভোট দিতে পারেনি। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনা পালানো এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে মানুষ ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছেন। অর্থনীতি চরম দুরবস্থায় পড়ে গেছে। বেকারত্ব বাড়ছে হুহু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। সবাই মনে করছে, নির্বাচন হলে সব সঙ্কট কেটে যাবে; অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। এ বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সেনাবাহিনীও চায় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হোক। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে কিছু প্রভাবশালী পদ-পদবিধারী ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদের স্বপ্ন দেখছেন। অন্তর্বর্তী সরকার যত বেশি দিন সরকারে থাকবে, ততই তারা ক্ষমতা উপভোগ করতে পারবেন। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চায়Ñ এমন প্রচারণাও চালিয়েছেন।

তাদের অনুসারী হয়েছেÑ নির্বাচন হলে ক্ষমতা দূরে চলে যাবে এমন একাধিক রাজনৈতিক দল। ওই দলগুলোর জনসমর্থনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আওয়াজ গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে। ভাবখানা ব্যাপক জনপ্রিয় দল। এমনকি ফরমায়েশি জরিপ করে মনগড়া ফলাফলও তুলে ধরা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রথমে ওই রাজনৈতিক শক্তি ‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন’ দাবি তোলে। পরবর্তীতে সংখ্যানুপাতির পদ্ধতির নির্বাচন, আগে গণভোট পরে জাতীয় নির্বাচন দাবিতে রাজপথ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করে। পাশাপাশি ওই দলের এক শীর্ষ নেতা বাংলাদেশ আক্রমণের জন্য ভারতকে উসকানি দেন এবং শিবিরের ৫০ লাখ তরুণ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে- এমন ঘোষণা দেন। এমনকি ওই দলের আমির ‘ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের রাজনীতি নয়’ এবং ‘হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বলতে ভালো লাগে না’ ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে দিল্লির অনুকম্পা আদায় করার চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে প্রকাশ্যে ভারত-বিরোধিতা এবং ভেতরে ভেতরে ওই দেশের নীতি-নির্ধারকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠন করলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারছে না জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। ওই দলটির তরুণ নেতারাও নানা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এখন ভারত-বিরোধিতাকে ইস্যু বানিয়ে মাঠে নেমেছেন। দিল্লিকে ক্ষেপিয়ে তুলতে সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্নের বক্তব্য দিচ্ছেন। আবার মধ্যপন্থি ধারার রাজনীতি করায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে থেকেই দেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গেছেন। তিনি দেশে এখন সব মত-পথের মানুষের কাছে সর্বজন গ্রহণযোগ্য নেতা হয়ে উঠেছেন। নির্বাচন হলেই তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ভূমিধস বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করবে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রশাসনে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ থাকবে না। যার কারণে ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টা ঘটনাকে ইস্যু করে হিন্দুত্ববাদী ভারত-বিরোধিতার নামে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখোপাত্র ওসমান হাদিকে দিনে-দুপুরে রাজপথে গুলি করার ঘটনায় মানুষ উদ্বিগ্ন। ভারতের একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুুল্লাহর ঘাড়ে গুলি করার কথা বলছেন। ভারত থেকে প্রচার করা হচ্ছেÑ নির্বাচনের আগে টার্গেট কিলিং হবে। ভারতের সেই প্রচারণায় বাংলাদেশের অনেকেই টার্গেট কিলিংয়ের আশঙ্কা করছেন। এমন অবস্থায় দেশে ফিরছেন তারেক রহমান। বিএনপির এই শীর্ষ নেতা দেশে ফিরে এলে গোটা রাজনীতি ঘুরে যাবে তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে।
এ অবস্থায় ভারত -বিরোধিতার নামে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টায় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল এবি পার্টির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী নিরাপত্তার দাবিতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনের ভেতরে এবং নির্বাচন হলে পরাজয় নিশ্চিত এমন রাজনৈতিক শক্তি ভারত-বিরোধিতাকে পুঁজি করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির করে দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেইÑ এমন প্রচারণায় নামতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এরা এত সুসংগঠিত ও পরিকল্পনা দিয়ে এগোতে পারে যে, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের কয়েকজন প্রার্থী নিরাপত্তা চেয়ে ইসিতে আবেদন করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ যারা নির্বাচন পেছানোর চেষ্টার নীলনকশা করছেন তারা নিজেদের প্রার্থীরা ছাড়াও বিএনপির দু’-চারজন প্রার্থীকে নিরাপত্তার জন্য আবেদন করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেন। ভারতে আশ্রিত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সব খুনিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়া এবং ‘ভারতীয় প্রক্সি রাজনৈতিক দল, মিডিয়া লীগ ও সরকারি কর্মকর্তাদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রে’র প্রতিবাদে জুলাই ঐক্যের ‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ কর্মসূচি কার্যত ভারত-বিরোধিতার নামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দিল্লিকে উসকে দিয়ে দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা।

উত্তেজনা সৃষ্টির টার্গেট : আল-জাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের গত ১৭ ডিসেম্বর বুধবার ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেনÑ ‘তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে ঘিরে একটি গোষ্ঠী উত্তেজনা তৈরির টার্গেট করেছে।’ ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেন- ‘বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থিদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে- ঠিক যখন তারেক রহমান দেশে ফিরছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

তারেক রহমানের দেশে ফেরা কেবল বিএনপির জন্য নয়- দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্যই একটি জরুরি বিষয়। কারণ জটিল সময়ে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা- তিন দিক থেকেই শক্ত নেতৃত্ব প্রয়োজন।
সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভরকেন্দ্রগুলো থেকে দ্রুত তার দেশে ফেরার তাগিদ দেখে তিনিও একরকম ঝুঁকির মুখেই ডিসেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে মাতৃভূমিতে ফিরছেন। সঙ্গত কারণেই এই মুহূর্তটি ব্যাপক কৌতূহল ও ভরসার হওয়ার কথা।

দক্ষিণপন্থিরা ঠিক এই মুহূর্তটিকে টার্গেট করেছে উত্তেজনা তৈরি করতে। ভারতের সাথে সম্পর্কটিকে যুদ্ধংদেহি করে তোলার জন্য এই সময়টিকে বেছে নেয়ার লক্ষ্য মূলত তারেক রহমানের দেশে ফেরার সামাজিক আবেদন কমানো। এই আয়োজনে ভারতের এখনকার শাসকদের দিক থেকেও বহু ধরনের লাভ আছে। প্রথমত, বিজেপি-আরএসএস বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও রাজনীতিকে তাদের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় ব্যাপক উন্মাদনা তৈরি করতে পারবে। সেটি ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এতে বাংলাদেশের চারপাশে নতুন করে সামরিক আয়োজনও বাড়াবে তারা। তৃৃতীয়ত, এর ফলে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী সব ভারতীয় রাজ্যে মুসলমান-বিদ্বেষ নতুন উচ্চতায় উঠছে। চতুর্থ, ‘নর্থ-ইস্ট ভাগ করে দেবো’, ‘দূতাবাসে ঢুকব’ এরকম হুমকিগুলো আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের ইদানীংকার ন্যারেটিভকে ন্যায্যতা দিচ্ছে।
ফলে সব মিলিয়ে নয়াদিল্লির জন্য বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থিদের উপহারের যেন কোনো শেষ নেই! আবার জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার পর জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তারেক রহমানকে একচেটিয়া উচ্চ সামাজিক ভাবমর্যাদা দেখতে চায় না নয়াদিল্লি। তাদের হয়ে সেই কাজটিও করে দিতে চলেছে এখানকার ‘ফার-রাইটরা’।
তবে, এটিও সত্য, বাংলাদেশের জনসমাজ বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের এই জায়গায় এসেছে। তাদের নীরব দৃঢ়তা নির্বাচনের রোডম্যাপকে বাস্তব করে তুলেছে।’

তাই ভারত-বিরোধিতার আড়ালে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে উদীয়মান ছদ্ম-রাজনৈতিক-যুদ্ধের তাৎপর্যও নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পারবে। সব মানুষকে তো সব সময়ের জন্য বার বার বোকা বানানো যায় না!
ভারতের বিরুদ্ধে স্নায়ু-লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার হলো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো, আর এসব প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।

আর সেটি বাস্তবায়নে উৎসবমুখর নির্বাচন এবং জনসমর্থিত শক্ত নেতৃত্ব হলো প্রাথমিক পদক্ষেপ, কেবল শক্তিশালী জনপ্রতিনিধিরাই ভারতের হাত থেকে অপরাধীদের নিয়ে আসতে এবং বাকি সব ন্যায্য স্বার্থ আদায় করতে পারে।