Image description

চরমোনাই মাদরাসার গণ্ডি পেরিয়ে রাজনীতির মাঠে নাম নতুন নয়। তবে এবার দৃশ্যপট আলাদা। দলের শীর্ষে থাকা পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম নিজে সরাসরি নির্বাচনে না থাকলেও, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার তিন ভাই চারটি আসনে দলীয় টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এতে দলীয় রাজনীতি ও পারিবারিক প্রভাবের প্রশ্ন ফের আলোচনায় এসেছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরমোনাই পরিবারের নাম সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে। সাংগঠনিক প্রভাব, মাঠপর্যায়ের তৎপরতা ও ভোটব্যাংকের উপস্থিতি থাকলেও নির্বাচনী ফলাফলের খাতায় চিত্রটি ভিন্ন। গত দুই দশকের নির্বাচনী পরিসংখ্যান বলছে, চরমোনাই পীরের পরিবারের রাজনীতিতে লড়াই আছে, কিন্তু জয় এখনো সীমিত।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ রেজাউল করিম, যিনি চরমোনাই পীর নামে পরিচিত, দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী।

তিনি বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি ও বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি। পাশাপাশি তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি। স্থানীয় সরকার রাজনীতিতেও তার পরিবারের উপস্থিতি পুরনো। সৈয়দ রেজাউল করিম ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা দুই মেয়াদে চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।

 পীরের পর চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব নেন তার ভাই সৈয়দ ইছহাক মুহাম্মদ আবুল খায়ের। তিনিও দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পীরের আরেক ভাই সৈয়দ মুহাম্মদ জিয়াউল করিম। তার চার ভাই সৈয়দ ইছহাক মুহাম্মাদ আবুল খায়ের, সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করিম, সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী এবং সৈয়দ মুহাম্মদ নুরুল করিম বিভিন্ন আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে কেউই নির্বাচিত হতে পারেননি।

যেভাবে রাজনীতিতে চরমোনাই পীর
চরমোনাই পীরের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার চর্চার পাশাপাশি তাঁর উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জীর হাত ধরে। তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সহ-সভাপতি ছিলেন। হাফেজ্জীর মৃত্যুর পর ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ তিনি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামে পরিচিত হয়। শুরুতে এটি ছিল ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভক্তি ও পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে পীর সাহেব চরমোনাই সৈয়দ ফজলুল করিমের নেতৃত্বে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলে রূপ নেয়।

১৯৯১ সাল থেকে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। ২০০৮ সালে নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পায় এবং হাতপাখা প্রতীক লাভ করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে ভোটের হিসাবে চতুর্থ স্থানে ছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এবার বরিশাল ও ঢাকার চারটি আসনে চরমোনাই পরিবারের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

পীরের ভাই কে কোথায় 
বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ-কাজিরহাট) আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন সৈয়দ ইছহাক মুহাম্মাদ আবুল খায়ের। তিনি ইসলামী আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব এবং চরমোনাই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক দুইবারের চেয়ারম্যান। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ পাওয়ার টেকনোলজি লিমিটেডের চেয়ারম্যান।

বরিশাল-৫ (বরিশাল সদর) আসনে প্রার্থী করা হয়েছে মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করিমকে, যিনি শায়খে চরমোনাই নামে পরিচিত। তিনি দলের সিনিয়র নায়েবে আমির। একই সঙ্গে বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির নায়েবে আমির, বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি। সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করিম বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনেও নির্বাচন করবেন। 

ঢাকা-৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাল আল মাদানী। তিনি ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং পীর সাহেবের মেজ ভাই। সম্প্রতি তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বোর্ড অব গভর্নরের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে চরমোনাই আহছানাবাদ রশীদিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করছেন। এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনে একই আসনে প্রার্থী ছিলেন তিনি। 

জয় কম, লড়াই বেশি
চরমোনাই পীরের দলের নির্বাচনী লড়াইয়ের যেমন ইতিহাস রয়েছে, তেমনি রয়েছে ধারাবাহিক পরাজয়ের ঘটনা। এই বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট বরিশাল-৫ আসনে। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ফয়জুল করিম লাঙ্গল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মজিবুর রহমান সারওয়ার ৫৯ দশমিক ৭০ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ পান ২৮ দশমিক ৮০ শতাংশ ভোট।

২০০৮ সালের নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে হাতপাখা প্রতীকে লড়েন সৈয়দ ফয়জুল করিম। তিনি ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে আবারও তৃতীয় অবস্থানে থাকেন। ওই নির্বাচনে বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার ৪৫ শতাংশ ভোটে জয়ী হন। আওয়ামী লীগের জাহিদ ফারুক শামীম পান ৪২ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মুফতী সৈয়দ মো. ফয়জুল করিম জামানত হারান। হাতপাখা প্রতীকে তিনি পান ২৭ হাজার ৬২ ভোট। ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীমকে দুই লাখ ১৫ হাজার ৮০ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপির অ্যাড. মজিবুর রহমান সরোয়ারের ভোট দেখানো হয় ৩১ হাজার ৩৬২।

জাতীয় সংসদের বাইরেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একই ধারা দেখা গেছে। ২০২৩ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করিম মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ফয়জুল করিমের ভোট দেখানো হয় ৩৩ হাজার ৮২৮।

নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে ফয়জুল করিম চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল বরিশাল সদর সিটি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি ২০২৩ সালের সিটি নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ফয়জুলকে বিজয়ী ঘোষণা করার আবেদন জানান। তবে শুনানি শেষে আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে দেন।

পীরের দুই ভাই ধরাছোঁয়ার বাইরে
বরিশাল-৪ (মেহেন্দিগঞ্জ-হিজলা) আসনেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নির্বাচনী চিত্র প্রায় একই রকম। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাল মাদানী পেয়েছিলেন ৯ দশমিক ২০ শতাংশ ভোট। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৪ আসনে দলীয় প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে নির্বাচন বর্জনের মধ্যেও তিনি ১২ হাজারের বেশি ভোট পান। তবে জয়ী হওয়ার মতো ভোটের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেননি।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ মুহাম্মদ নুরুল করিম। ভোটের দিন দুপুরেই তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। ফলাফলে তাঁর ভোট দেখানো হয় সাত হাজার ৮৯৪। নুরুল করিম ঢাকায় বসবাস করেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আর প্রার্থী হননি।

এসব হিসাব একত্রে ধরলে ইসলামী আন্দোলনের ভোট ব্যাংকের একটি সীমা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অধিকাংশ আসনে দলটির ভোটের হার ঘোরে আট থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে। স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠন শক্তিশালী হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই ভোট এখনো নির্ধারক হয়ে ওঠেনি।