Image description
 

১৬ বছরের মালিহা দশম শ্রেণির ছাত্রী। তার বয়স যখন তিন মাস তখন তার বাবাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবার আদর কী, তা সে জানে না। বুধবার রাতে ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকা এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে অপেক্ষা করছে উৎকণ্ঠা নিয়ে। বাবা আসবে, তাকে জড়িয়ে ধরবে। আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাবাকে জড়িয়ে অঝরে কাঁদছিল। কাঁদছিল তার বাবাও।

 
 

কান্না করতে করতে মালিহা বলছিল, ‘১৬ বছর আগে বাবা কারাগারে গিয়েছিল। আমি আমার বাবার আদর পাইনি এতদিন। বাবা কী জিনিস আমি আমার জীবনে বুঝি নাই। কখনো ভাবিও নাই হঠাৎ করেই আমার বাবা এভাবে মুক্তি পাবে। আমার বাবা এখন মুক্ত। বাবাকে নিয়ে অনেক ঘুরব, অনেক কথা বলব।’

 

গতকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও গাজীরপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার সামনে বসে মিলনমেলা। ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া ব্যক্তিরা বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গত রবিবার জামিন পান। আসামিপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ আদালত তাদের জামিন দেয়। এরই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ৪৩ জন এবং কাশিমপুর কারাগার থেকে ১২৬ জন মুক্তি পান। ভোর থেকেই ফুল নিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে ভিড় করেছিলেন বিডিআর সদস্যদের স্বজনরা।

 

কলেজছাত্রী ইলমা ইসলামের বয়স এখন ২০। তার বাবা বিডিআর সদস্য জহিরুল ইসলামকে যখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তার বয়স ছিল ৪। কিশোরগঞ্জ থেকে মাকে নিয়ে এসেছেন কেরানীগঞ্জে বাবাকে কারামুক্তির পর নিয়ে যাওয়ার জন্য। ইলমা জানান, দীর্ঘ এতটা বছর বাবা ছাড়া অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হয়েছে। তার মা এতদিন অনেক কষ্ট করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। বাবা থাকতেও ছিলেন না। বাবাকে ফিরে পাওয়াটা তার জন্য অনেকটা স্বপ্নের মতো। ১৬ বছর পর বাবাকে জড়িয়ে ধরে ইলমার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস দেখা যায়।

 

সত্তরোর্ধ্ব আবদুল খালেক ময়মনসিংহ থেকে ছোট ছেলে আরমানকে নিয়ে এসেছেন বড় ছেলে সিপাহি আল-আমিনকে কারামুক্তির পর বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আবদুল খালেক বলেন, ‘গত ১৬ বছরে ৩২টা ঈদ আমার পরিবারের কাছে ঈদ মনে হয় নাই। আমরা প্রতিটা ঈদে এখানে আসতাম বড় ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। বিনা অপরাধে আমার ছেলেটারে ১৬ বছর আটকায়া রাখসে। ঈদের দিন আসতাম, খাবার দিতাম, চলে যাইতাম, ওর সাথে কোলাকুলি পর্যন্ত করতে পারতাম না।’

 

হাজারীবাগ থেকে কারাগারের ফটকে এসেছেন রুবিনা আক্তার। তার ভাই বিডিআর সদস্য সামসুদ্দিনকে নিতে। রুবিনা জানান, তার ভাইয়ের স্ত্রী দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছে। তারা ধরেই নিয়েছিল তার ভাই আর হয়তো কখনো ছাড়া পাবে না। এ কারণে তারাও ভাইয়ের স্ত্রী অন্যত্র চলে যাওয়ায় বাধা দেননি।

 

কাশিমপুর থেকে জামিন পেলেন ১২৬ বিডিআর সদস্য : কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একে একে বের হয়ে আসছেন বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় জামিন পাওয়া বিডিআর সদস্যরা। কারাগার থেকে বের হয়ে আসামাত্রই কারা ফটকের বাইরে অপেক্ষায় থাকা স্বজনরা তাদের জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

গতকাল সকাল থেকে গাজীপুরের তিনটি কারাগার থেকে পর্যায়ক্রমে বিডিআর সদস্যরা বের হতে থাকেন। দুপুরের মধ্যে জামিনপ্রাপ্ত সব সদস্য কারাগার থেকে বের হন।

এদিকে প্রিয় স্বজনদের কারামুক্তির খবরে কাশিমপুর কারা ফটকের সামনে সকাল থেকেই স্বজনরা ভিড় করতে থাকে। অনেকের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানরাও কারা ফটকে ছুটে আসেন। প্রিয় স্বজনকে কাছে পেয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। অনেকে ফুল দিয়ে স্বজনদের বরণ করেন। বিডিআর সদস্যদের কারামুক্তি পাওয়ার বিষয়টি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জামিনে কারামুক্ত বিডিআর সদস্যদের মধ্যে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ থেকে ২৪, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে ৮৯ ও হাই-সিকিউরিটি কারাগার থেকে ১৩ জন মুক্তিলাভ করেন।

গত ২২ জানুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহ মামলার ১২৬ আসামির জামিননামা কাশিমপুরের তিনটি কারাগারে পাঠানো হয়। সেসব জামিননামা যাচাই-বাছাই শেষে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকায় বন্দিদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।

এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত ও যাদের বিরুদ্ধে কোনো আপিল হয়নি এমন দুই শতাধিক আসামিকে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক জামিন দেন।