উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের একটি ফেসবুক পোস্ট দেশের চলমান রাজনীতিকে আবারো গরম করে তুলেছে। বৃহষ্পতিবার দেয়া ওই পোস্টে নাহিদ ইসলাম যেমন সেনাশাসনের ইঙ্গিত দিলেন, তেমনি১/১১ ফিরে আসার শঙ্কার কথাও প্রকাশ করলেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের মন্তব্যের জের ধরে নাহিদ ইসলাম আবার বাংলাদেশে ১/১১ ফিরে আসার ইঙ্গিতের কথা বলছেন। অন্যদিকে সেনাশাসন বা জরুরি অবস্থা মেনে নেয়া হবে না বলে যে মন্তব্য করেছেন, তাতেই নড়েচড়ে বসেছে সাধারণ মানুষ। হঠাৎ সেনা শাসনের কথা কেন বললেন তিনি? তাহলে কি ভেতরে ভেতরে এমন কিছু হচ্ছে?
এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সমাজ পাতায়। সেনা শাসনের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে নাহিদ ইসলামের পোস্টের কয়েকটি লাইনের কারণে। তিনি লিখেছেন, আমরা তিন আগস্ট থেকে বলে আসছি, কোনো প্রকারের সেনাশাসন বা জরুরি অবস্থা মেনে নেব না। আমাদেরকে বারবার ক্যান্টনমেন্টে যেতে বলা হলেও আমরা যেতে অস্বীকার করি। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে আলোচনা ও বার্গেনিং এর মাধ্যমে ডক্টর ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
হাসিনা সরকার পতনের পাঁচ মাস পরে এসে পুরনো কথা বলতে গিয়ে ফের সবাইকে সেনা শাসনে তাদের নারাজির বিষয়টি মনে করিয়ে দেবার কারণ কি? তাহলে কি সেরকম কোনো ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে?নাহিদুল ইসলামের এই পোস্টে এমন প্রশ্ন এখন সচেতন থেকে সাধারণ মনেও উঁকিঝুঁকি মারছে।
এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশে এখন জিয়াবাদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। জিয়াউর রহমান তথা বিএনপিকে নিয়ে নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীর এমন মন্তব্য নিশ্চিত করেছে যে, দলটির সাথে সমন্বয়কের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। নাহিদ ইসলামের দীর্ঘ পোস্টটি পড়লে যে কেউ অনুমান করতে পারবে এখন আর বনিবনা হচ্ছে না বিএনপির সাথে সমন্বয়কের আর সমন্বয়ক থেকে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাওয়া আসিফ ও নাহিদের। সেনাশাসন বা জরুরি অবস্থার বিষয়টি ছাড়া। নাহিদ ইসলাম তার পোস্টে যে দীর্ঘ কথা লিখেছেন, তাতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া।
বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। ১/১১ বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি মহাসচিবের মন্তব্যে সামনে আরেকটা এক এক সরকার সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা ও গুম, খুন ও জুলাই হত্যাকান্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।
ছাত্র এবং অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে মাইনাস করার পরিকল্পনা পাঁচ আগস্ট থেকেই শুরু হয়েছে। ৫ আগস্ট যখন ছাত্র জনতা রাজপথে লড়াই করছে, পুলিশের গুলি অব্যাহত রয়েছে, তখন আমাদের আপসকামী অনেক জাতীয় নেতৃবৃন্দ ক্যান্টনমেন্টের জনগণকে বাদ দিয়ে নতুন সরকার গড়ার পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন।
অনেকে ছাত্রদের কথাও বলেছেন সেখানে। আমরা চেয়েছিলাম ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটা জাতীয় সরকার। জাতীয় সরকার হলে হয়তো ছাত্রদের সরকারে আসার প্রয়োজন হতো না। জাতীয় সরকার অনেক দিন স্থায়ী হবে। এই বিবেচনায় বিএনপি জাতীয় সরকারে রাজি হয়নি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরেই দেশের জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল।
অথচ বিএনপি জাতীয় সরকারের কথা বলছে সামনের নির্বাচনের পর। ছাত্ররাই এই সরকারের এবং বিদ্যমান বাস্তবতার একমাত্র ফ্যাক্টর, যেখানে ১/১১ সরকার থেকে বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে বিএনপি। কয়েক দিন আগে মাইনাস টু এর আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি ১/১১ সরকারের প্রস্তাবনা করছে।
এ ধরনের পরিকল্পনা গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে এবং ছাত্রজনতা কোনোভাবেই এটা মেনে নেবে না এবং আমি মনে করি এটা বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আর এই সরকার জাতীয় সরকার না হলেও আন্দোলনে সব পক্ষেরই অংশীদারিত্ব রয়েছে এবং সব পক্ষই নানান সুবিধা ভোগ করছে। সরকার গঠনের আগেই ছয় অগাস্ট অ্যাটর্নি জেনারেল এবং পুলিশের আগের আইজি নিয়োগ হয়েছিল, যারা মূলত বিএনপির লোক। এরকমভাবে সরকারের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত নানান স্তরে বিএনপি পন্থী লোকজন রয়েছে। নির্বাচনের নিরপেক্ষতার কথা বললে এই বাস্তবতাও মাথায় রাখতে হবে।
রাষ্ট্রপতির পরিবর্তন, সংস্কার, নতুন সংবিধান, জুলাই ঘোষণা সব ইস্যুতেই বিএনপি বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অথচ এগুলো কোনোটাই ছাত্রদের দলীয় কোনো দাবি ছিল না। কিন্তু দেশের স্থিতিশীলতা, বৃহত্তর স্বার্থ এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য ছাত্ররা বারবার তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
কিন্তু এর মানে এই না যে, গণতন্ত্র বিরোধী ও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বিরোধী কোনো পরিকল্পনা হলে সেখানে আমরা বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিব।
আওয়ামী লীগ বিষয়ে ভারতের প্রধান দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সম্ভব হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিষয়ে আমরা ঐক্য করতে পারিনি। এত হত্যা ও অপরাধের পরেও এই জাতীয় ঐক্য নিয়ে আমরা কী রাষ্ট্র বানাব? বাংলাদেশকে দুর্বল করা সহজ। কারণ বাংলাদেশকে সহজেই বিভাজিত করা যায়। এ দেশের বড় বড় লোকেরা অল্প মূল্যে বিক্রি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে।
আমি মনে করি না সমগ্র বিএনপি এই অবস্থান গ্রহণ করে। বরং বিএনপির কর্মী সমর্থকদের বড় অংশই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন চায়। বিএনপির দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী নেতৃত্বকে আহ্বান করব ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে না গিয়ে ছাত্র জনতার সাথে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির পথ বেছে নিন।