২০০২ সালে বিশ্বখ্যাত জেমস বন্ড সিরিজের ‘হানি ট্র্যাপ’ নামে একটি থ্রিলার ছবি মুক্তি পায়। সিনেমার নায়ক জোনাথন ও নায়িকা ক্যাথেরিন। তাদের প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ হচ্ছে সিনেমার গল্প। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় হয় পাশের ফ্ল্যাটের রিনির সঙ্গে। একপর্যায়ে স্ত্রী ক্যাথেরিন স্বামী জোনাথনের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করেন। এ ব্যাপারে রিনির সহায়তা চান। ক্যাথেরিনের সঙ্গে প্রাইভেট গোয়েন্দা জেরেমির পরিচয় করিয়ে দেয় রিনি। জোনাথনকে বিপদে ফেলতে ‘হানি ট্র্যাপ’ পাতেন গোয়েন্দা জেরেমি। সেই হানি ট্র্যাপই তাদের দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ ঘটায়।
‘হানি ট্র্যাপ’ সিনেমার মতোই হঠাৎ করে দেশের রাজনীতির এই উথাল-পাতাল বিতর্কে মনে হচ্ছে সবাই যেন ভারতের ‘ষড়যন্ত্র ট্র্যাপে’ পা দিচ্ছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের, ‘সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে’ বক্তব্য; তার জবাবে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টার ‘বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন চাচ্ছে’ বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিএনপি-ছাত্র সমন্বয়কদের এই বিতর্র্কের আগুনে ঘি ঢালছেন কেউ কেউ। প্রশ্ন হচ্ছে এখন কী বিতর্কের সময়? ১৫ বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করায় সাড়ে পাঁচ মাসেও দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক হয়নি। সামনে আসছে পবিত্র রমজান মাস। রমজান মাসে পণ্যমূল্যের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের আয় রোজগারের ক্ষেত্র সচল রাখা আবশ্যক। এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে বিরোধ? ভারত প্রতিদিন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ‘নখ’ শানাচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অপপ্রচার চালাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সরকারের কাছে নিজের চরকায় তেল না দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রন্ত্রী ড. জয়শঙ্কর বাংলাদেশের চরকায় তেল দিয়েছে। দিল্লিতে বসে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পাচার করা লুটের টাকা খরচ করে বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বে জনমত গঠনের চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কুশীলবদের ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু হঠাৎ করে নিজেদের মধ্যে বিরোধ বাঁধাচ্ছে কারা? এতে কার লাভ?
দেশ-বিদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হবে। তার ভাষায়Ñ ‘নির্বাচনের ট্রেন লাইনে উঠেছে, এই ট্রেন আর থামবে না’। তিনি এটিও বলেছেন, ‘সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে চাইবে সেভাবে হবে; নির্বাচন দিয়ে আমরা চলে যাব।’ তারপরও কেন এ বিতর্ক? এটা ঠিক, ফ্যাসিস্ট হাসিনার ১৫ বছর ‘আগে উন্নয়ন পরে নির্বাচন’ থিউরি প্রচার করা হতো। এখন কেউ কেউ প্রচার করছে ‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন’ থিউরি। সঙ্গত কারণে রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে। কিন্তু সেটা নিয়ে ‘পানি এত ঘোলা’র রহস্য কি? অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দল সবার কমন শত্রু ফ্যাসিস্ট হাসিনা আর আওয়ামী লীগ। দাদাদের ঘরে বসেই হাসিনা বেশ কয়েকবার দেশে ফেরার হুঙ্কার দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি দিল্লির হেফাজতে থেকে নানামুখী ষড়যন্ত্র করছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারত পালিয়ে গেলেও হাসিনা এখন দেশে অবস্থানরত তার অলিগার্ক প্রশাসনের আমলা, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছেন। এ সময় ৫ আগস্টের চেতনায় বিশ্বাসী সবার ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের আগের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আয়োজিত সংলাপের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারপরও কেন এ বিরোধ-বিতর্ক?
হাসিনার ভারতের পালানোর পর এক মিনিটের জন্যও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তার ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রতিদিন তিনি গুজব ছড়াচ্ছেন, ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নেতৃত্ব দিলেও সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণিপেশার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। ফলে শেখ হাসিনা দেশের রাজনৈতিক দলসহ ১৮ কোটি মানুষের উপর বিক্ষুব্ধ। জুডিশিয়াল ক্যু থেকে শুরু করে পাহাড়ে অশান্তিÑ সব ধরনের ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করে ব্যর্থ হাসিনার মুরুব্বি দিল্লির রাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্করা বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে ‘শত্রু’ ভাবছেন। এখন নিজেদের ঐক্যে ফাটল ধরলে সেটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে হাসিনা ও ভারত। অথচ দেশের রাজনীতিক ও ছাত্রনেতারা ইচ্ছা করেই হোক আর অজান্তেই হোক, সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে। বর্তমান বাস্তবতায় সারা দেশে বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন বেশি থাকলেও কিছু কিছু ইস্যুতে বিএনপির প্রতি মানুষের মান-অভিমান রয়েছে। দলটির নেতারা ’৭২-এর সংবিধান নিয়ে মায়াকান্না, প্রেসিডেন্ট অপসারণের বিরুদ্ধে অবস্থান, ভারত অখুশি হয় এমন বক্তব্য থেকে সতর্ক থাকা ইত্যাদি ইস্যুতে মানুষের ক্ষোভ আছে। পক্ষান্তরে হাসিনার ভারত বর্জন, হাসিনার বিচার, ভারতের প্রতি চ্যালেঞ্চ ছুড়ে দেয়া এবং বিদেশে টাকা পাচারকারী হাসিনার অলিগার্কদের বিচারের ব্যাপারে ছাত্রনেতারা সোচ্চার। ছাত্রনেতাদের এ অবস্থান ১৮ কোটি মানুষ সমর্থন করছে। ফলে বিএনপি মহাসচিবের ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ ইস্যুতে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মহানায়কদের একসঙ্গে মৌমাছির মতো বিএনপি মহাসচিবের ওপর ‘হুল ফুঁটানো’ কী শুভবুদ্ধির পরিচয়? এর মধ্যেই ‘মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট’ প্রবাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা ছাত্র সমন্বয়ক ও বিএনপির মুখোমুখি বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালছে। দলটির নেতা গতকালও কুড়িগ্রামে এক সমাবেশে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৮ কোটি মানুষের উপর জুলুম করেছে। মানুষ খুন করে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিল। ফ্যাসিস্টরা যেন পুনরায় ফিরে না আসে এবং আমরা যেন তাদের আশ্রয়-প্রশয় না দিই। এমন কোনো কর্মকা- করবেন না যাতে আমাদের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। চাঁদাবাজি ও দখল-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হলে পুনরায় স্বৈরাচার ফিরে আসার সুযোগ পাবে। অটুট থেকে মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হবে।’ অথচ এই নেতা কয়েক দিন আগে লন্ডনে গিয়ে বলেছেন, ‘হাসিনাকে বার বার ফ্যাসিস্ট বলতে ভালো লাগে না’। ‘আমরা ভারতের বিরুদ্ধে নই’। বিএনপি ও ছাত্রদের বিতর্ক উসকে দিতে গতকাল কুমিল্লায় দলটির একজন নায়েবে আমীর বলেছেন, ‘গত দু-তিন দিন ধরে ছাত্রদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে একটি চক্র। সেসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদমুক্ত বসবাসযোগ্য যে বাংলাদেশ চেয়েছিল ছাত্ররা, সেই ছাত্রদের সঙ্গে এখন তর্কে জড়াচ্ছেন তারা।’
ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া এখন ওপেন সিক্রেট। দেশের সব বিভাগের প্রতিনিধির সঙ্গে গতকাল বৈঠক করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতারা। এর কয়েক দিন আগে তারা রাজনৈতিক দল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা জেলা কমিটি ছাড়াও ২১০টি উপজেলায় কমিটি করেছে। এটি পরিষ্কার, ৫ আগস্টের মহানায়ক ছাত্রনেতারা আগামী ত্রায়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হচ্ছে। সেটি বুঝতে পেরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার দলের অবস্থান তুলে ধরেন। ফখরুলের বার্তা হচ্ছেÑ দল গঠনে বাঁধা নেই। কিন্তু সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করলে সরকার থেকে বেরিয়ে এসে সেটি করা উচিত। উপদেষ্টাদের কেউ রাজনীতি করলে সরকার থেকে বের হয়েই করবে।’ নতুন কোনো দল গঠনে অন্তর্বর্তী সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করছে নাÑ জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘সরকারের কোনো উপদেষ্টা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সঙ্গে যুক্ত হলে তারা সরকারে থাকবেন না।’ এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টা রাজনীতির সাথে জড়িত নন এবং তাই কেউ নির্বাচন করবে না। যদি কেউ নির্বাচন করতে চান, তবে তাদের উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে।’ অন্তর্বর্তী সরকারের বক্তব্য পরিষ্কার। তাহলে বিরোধ হচ্ছে কেন? পর্দার আড়াল থেকে কেউ কি বিরোধ বাঁধিয়ে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্যÑ ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ও জুলাই স্পিরিট ধারণকারী ছাত্র-জনতার সম্মিলনে যখন নতুন একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান হওয়ার আভাস পেলো ঠিক তখন বিএনপি সেটিকে চিহ্নিত করল তাদের দলীয় স্বার্থের বিপক্ষে হুমকি হিসেবে।’ জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘দেশে মুজিববাদ, জিয়াবাদ আর চলবে না।’ প্রশ্ন হচ্ছেÑ সত্যিই কি দেশে জিয়াবাদ দর্শনের অস্থিত্ব ছিল? ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের আগ পর্যন্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) পরিচিত ছিল। তখন জাসদ ছাত্রলীগ, জাগপা ছাত্রলীগ, বাসদ ছাত্রলীগ থাকায় ‘মুজিববাদ’ শব্দ ছিল। তাছাড়া হাসিনা গত ১৫ বছর দেশে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। আবার পাকিস্তানের নাগরিক মাওলানা আবু আলা মওদূদী জামায়াত প্রতিষ্ঠা করায় দেশের বাম নেতারা জামায়াতকে ‘মওদূদীবাদী’ তকমা দিয়ে থাকে। তাহলে দেশে মুজিববাদ ও মওদূদীবাদ শব্দ দুটির অস্থিত্ব ছিল। কিন্তু জিয়াবাদ ছিল না। অথচ ওই ছাত্রনেতা মুজিববাদ, জিয়াবাদ থাকবে না বললেও মওদূদীবাদ নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। মওদূদীবাদের প্রতি ওই ছাত্রনেতার দরদের রহস্য কী? অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘এক-এগারোর সঙ্গে বিএনপিকে যুক্ত করে ভিন্ন শিবিরে (আওয়ামী লীগ) ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। এর পরিণতি ভালো হবে না। এক-এগারো নয়, যদি আপনারা এই ৫ আগস্টের পরে এ ধরনের কথা-বার্তা, সঙ্ঘাত-বিভেদ সৃষ্টির কথা আজকে বলতে থাকেন, তাহলে কিন্তু গণতন্ত্রের কোনো দিন চেহারা দেখা যাবে ন।’ আবার বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তারা যদি নির্বাচন করে, তবে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে নির্বাচন করবে। তাতে বিএনপির কিছু আসে-যায় না।’ এ যেন প্যান্ডোরার বক্স খোলার প্রতিযোগিতা!
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আন্তর্জাতিক মহল সব ধরনের সমর্থন জানালেও এখনো দেশের অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ফেরেনি। রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গেছে এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার করা বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হচ্ছে, তারপরও ব্যাংকিং সেক্টরে এখনো অস্থিরতা চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে এখনো ‘চেইন অব কমান্ড’ প্রতিষ্ঠা হয়নি। বেক্সিমকোসহ অনেকগুলো মিলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারত্ব বাড়ছে। কিছুদিন পর পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। এখন এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। সেগুলোর বদলে সরকারের কিছু উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক দল একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। ৫ আগস্টের সুফলভোগীদের নিজেদের মধ্যেকার কামড়াকামড়িকে পুঁজি করে পলাতক হাসিনা হায়েনার মতো হিং¯্র থাবা বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাসিনার নীলনকশায় সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে ‘ফেইক’ তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। দেশে এবং বিদেশে থাকা হাসিনার অলিগার্করা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। তারা বিএনপির সঙ্গে ছাত্রনেতাদের বিরোধ জিইয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। যার কারণে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দিল্লির তাঁবেদার গণমাধ্যমগুলো বিএনপির মির্জা ফখরুল ও উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বক্তব্যকে ফলাও করে প্রচার করছে।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্য প্রসঙ্গে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘আমি মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের মূল নির্যাস যেটা বুঝেছি সেটি হলোÑ সরকার যেন নিরপেক্ষতা হারিয়ে না ফেলে। আমি মনে করি, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সরকারের নিরপেক্ষতা হারানোর কোনো সুযোগ নেই।’ ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয়, অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’ (সুভাষ মুখোপাধ্যায়)। কবির এই কবিতার মতোই হাসিনার মুরুব্বি দিল্লির সঙ্গে যুদ্ধের মুখোমুখি দেশের ১৮ কোটি মানুষ। এখন বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কারোই ‘ফুল খেলবার’ সময় নয়। এ অবস্থায় হানি ট্র্যাপের মতোই ভারতের ‘ষড়যন্ত্র ট্র্যাপে’ পড়া সবার জন্য আত্মঘাতী। তবে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। জনগণের কল্যাণে কে কত অগ্রগামী এই চেষ্টা/ডিবেট থাকবে। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ফ্যাসিবাদী শক্তি ব্যতীত কারো সাথে কারো শত্রুতা থাকবে না। অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে প্রয়োজন মতানৈক্য সত্ত্বেও কিছু বেসিক প্রিন্সিপালে সবাই ঐকমত্য। তাহলেই বহিঃশত্রুরা আমাদেরকে আমাদেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না। ক্ষুদ্র ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে দেশকে।