মানুষের সঙ্গে নদীর প্রাণের সম্পর্ক দীর্ঘকাল। নদীর তীরে বসতি গড়ে সখ্য করেছে নদীর সঙ্গে বাংলার আপামর জনগণ। নদী হয়েছে আপনজন। তবে, এই নদীর সঙ্গে মানুষের বৈরিতাও কম নয়! বন্যা, হঠাৎ পাহাড়ি ঢল ও ভাঙন নদীপাড়ের মানুষের জীবনকে কখনো কখনো ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
তবুও, নদীপাড়ের মানুষ নদীকেই ভালোবেসে সুখের বসতি গড়ে, স্বপ্ন বুনে আগামীর। সারাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা হাজারো নদ-নদীই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ত্বরান্বিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে অসংখ্য যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল খোদ নদীতেই। নদীতে সংঘটিত ছোট-বড় এসব যুদ্ধে বীর বাঙালির কাছে পরাস্ত হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
এসব নদী দিয়েই ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল লাখো বাঙালি। আগরতলায় স্থাপিত ইয়ুথ রিলিফ ক্যাম্পের নামকরণও করা হয়েছিল নদীর নামে—পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, গঙ্গা ইত্যাদি।
সে সময় সীমান্তের এক-একটা নদী হয়ে উঠেছিল আশ্রয়প্রার্থী অসহায় মানুষগুলোর বিশ্বস্ত বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির অন্যতম প্রিয় স্লোগান ছিল 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।'
শুধু পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নয়, বাংলার প্রায় সব নদ-নদীই হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির ঠিকানা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অগণিত গণহত্যা সংগঠিত করে বাংলার নদ-নদীর তীরেই। তারা বাঙালিদের হত্যা করে মরদেহ ফেলতো নদীতে।
অসহায়, নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অব্যাহত নির্মম নির্যাতনে রক্তস্রোতে বাংলার সব নদী ফুঁসে ওঠে হানাদারদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নদী হয়ে ওঠে সহায়ক শক্তি।
নদ-নদী বিধৌত বাংলায় বেড়ে ওঠা দামাল ছেলেদের কাছে সবকিছুই ছিল পরিচিত। হাতে অস্ত্র নিয়ে নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে কখনো বা পানিতে ডুবাতে ডুবাতে যুদ্ধ করেছেন তারা। পক্ষান্তরে পাকিস্তানিদের কাছে তা একেবারেই অপরিচিত পরিবেশ।
এই সুযোগটাই কাজে লাগায় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা। নদী পথের লড়াইকে আরও জোরালো করার লক্ষে প্রতিষ্ঠা করা হয় নৌ-কমান্ডো দল। সারাদেশের নদীপথে গেরিলা অপারেশন চালানোর জন্য এই দল তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নৌ-কমান্ডো, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথ দশ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। এই সেক্টরে পদস্থ কর্মকর্তা না থাকায় ছিল না কোনো অধিনায়ক। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান দশম সেক্টরে প্রথম নৌবাহিনীর শুভ উদ্বোধন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এই নদীকে কেন্দ্র করেই সমর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। এর প্রধান কারণ বাংলার এই অঞ্চলটিই নদ-নদী প্রধান। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার লেখায়।
তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ঢাকা। যেভাবেই হোক ঢাকা পৌঁছাতে হবে, ঢাকাকে দখল করে নিতে হবে। আর এই কাজটি যত দ্রুত সম্ভব হবে, পাকিস্তানিদের পরাজয় তত সহজতর হবে। আর তা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সব দিক থেকে শত্রুদের বহুমুখী আক্রমণ চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের ভাবনার অগ্রভাগে ছিল নদী। পূর্ব বাংলাকে নদী দিয়ে বিভক্ত করে এলাকা অনুযায়ী চারটি সেক্টরে ভাগ করে সে অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করলে লক্ষ্য পূরণ সহজ হবে, এটাই ছিল পরিকল্পনা।
একইভাবে পাকিস্তানি লেফট্যানেন্ট জেনারেল এ কে নিয়াজি ১৯৭১ সালে যুদ্ধে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে সেনা মোতায়েন করেছিলেন এবং তাতে নদীই ছিল গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার অংশ।
১৯৯৮ সালে প্রকাশিত তার লেখা 'দ্য বিট্রেয়াল অব ইষ্ট পাকিস্তান' বইতে লিখেন, '...সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত। দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ছোট একটি অংশ বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। চতুর্থ দিকে আছে বঙ্গোপসাগর। মূলত পূর্ব পাকিস্তান একটি নিম্নভূমি, যার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য নদী ও জলধারা। সেখানকার তিন প্রধান নদী হলো পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। বর্ষার সময় এই নদীগুলো সমুদ্রের মতো হয়ে যায়।
এই নদীগুলোর আবার অসংখ্য শাখা ও উপনদী আছে, যার কারণে এই অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত প্রতিকূল। পুরো পূর্ব পাকিস্তানে কেবল ভৈরব ও পাকশীতে দুটি সেতু ছিল। সড়ক ও সেতুর অভাবে নৌকা ও ফেরি এই অঞ্চলে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। এটি যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি গেরিলাযুদ্ধ মোকাবিলায় অনেক ঝামেলাপূর্ণ। এতে করে গেরিলাদের হঠাৎ আক্রমণের মুখে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। দ্রুত নদীর প্রতিবন্ধকতা দূর করার একমাত্র সমাধান হলো আকাশপথ, ১৯৭১ সালে ভারতীয়রা ঠিক এটাই করেছিল, অথবা নদীর উভয় পাড়ে প্যারাট্রুপার নামানো।
সেখানকার আবহাওয়া খুবই উষ্ণ ও আর্দ্র। বর্ষাকালের স্থায়িত্ব অনেক বেশি এবং তখন খুব ভারী বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষার সময় আর্দ্রতা এত বেড়ে যায় যে যারা এর সঙ্গে ধাতস্থ নয়, তাদের পক্ষে এটি সহ্য করা খুবই কঠিন। এই আবহাওয়া মানুষের শক্তি শুষে নেয়। এই স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া শুষ্ক অঞ্চলের মানুষের জন্য বিপজ্জনক। এই পরিবেশে নানা রকম রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া সবচেয়ে বিপজ্জনক। জোঁকসহ অনেক রকম বিপজ্জনক কীটের উপদ্রব দেখা দেয়। ঠিকঠাক সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে এই আবহাওয়া ও কীটপতঙ্গ সেনাদের জন্য বুলেটের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।'
তিনি আরও লিখেন, 'আমার সেনারা ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের শুষ্ক অঞ্চলের। অনেকেই জীবনে বড় নদী দেখেনি এবং তারা এও জানতো না, নাভির চেয়ে বেশি উচ্চতার পানিতে কীভাবে হাঁটা যায়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাঁচ-ছয় মাইল অন্তর নদী বা খাল-বিল আছে। আর বড় নদীগুলো তো আমাদের কাছে সাগরের মতো। তাই তাদের অভিযানের মধ্য দিয়েই সাঁতার, নৌকা চালানো, পানির মধ্য দিয়ে হাঁটা সবকিছুই শিখতে হয়েছে। এসব কারণে আমাদের চলাচল ব্যাহত হয়েছে, বিশেষ করে বর্ষাকালে।' (১৯৭১: শত্রু ও মিত্রের কলমে; সম্পাদনা: মতিউর রহমান; অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন)
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ যে বাংলার নদ-নদী তা নিয়াজির এই বক্তব্যে স্পষ্টতই বোঝা যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ভাগীরথী নদীর তীরে। নদীটি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবাহিত। ভাগীরথী নদীর তীরে যে মাঠটিতে নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ হয়েছিল সেটিই ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তর। যে মাঠে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটে।
নৌ-কমান্ডোদের এই প্রশিক্ষণ পরে যারা যোগ দেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের ছাত্র এবং চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার তরুণ-যুবক। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী এই যুবকেরা পূর্ব বাংলার খরস্রোতা নদীগুলো থেকে যথাসম্ভব সুবিধা নেওয়ার মতো সাঁতারের কৌশল জানতেন।
সম্পূর্ণ অন্ধকারে তাদের মাইলে পর মাইল সাঁতরাতে হতো, বা বাঁশ বা পেঁপে পাতার চোঙা দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে পানিতে মাইন বহন করে শত্রুপক্ষের কাছাকাছি রেখে সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই সাঁতরে নিরাপদ দূরত্বে ফিরে আসতে হতো।
এ ধরনের কঠিন কাজের জন্য যে দৈহিক ও মানসিক শক্তিমত্তার প্রয়োজন, পূর্ব বাংলার তরুণদের তা প্রচুর পরিমাণে ছিল। তাই সাঁতারু বা ফ্রগমেন বাহিনীর নেতৃত্ব শুরুর দিকে নৌবাহিনীর সদস্যদের হাতে থাকলেও অচিরেই তা চলে যায় বিপুলভাবে উদ্দীপিত শিক্ষিত যুবকদের হাতে।
ভাগীরথীর তীরে ১২ জুন থেকে তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। নদীমাতৃক বাংলার সাথে নৌ-পথে পাকিস্তানিদের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াই ছিল প্রশিক্ষিত নৌ-কমান্ডোদের প্রধান উদ্দেশ্য।
চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা বন্দর, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর নদী বন্দরকে কমান্ডো হামলার লক্ষ্যস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে সেভাবেই পরিকল্পনামাফিক হামলা চালিয়ে পাকিস্তানিদের নৌশক্তিকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। এখানকারই একটি ৩১ সদস্যের নৌ-কমান্ডো টিম ১৪ আগস্ট রাতে অপারেশন চালায় চট্টগ্রাম নদী বন্দরে।
সেদিন শুধু চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতেই নয়, নৌ-কমান্ডোরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে একযোগে চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করে পাকিস্তান বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেয়। এতে দুর্বল হয়ে পরে পাকিস্তানি বাহিনীর নৌশক্তি।
অপারেশন 'জ্যাকপট' খ্যাত দুঃসাহসিক সেই অভিযানে হানাদারদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। পরে সেই অপারেশনের কথা ফলাওভাবে প্রচার হয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা।
আমরা এখন বর্ষার অপেক্ষায় রয়েছি...। তারা পানিকে এতো ভয় পায়, আপনি ভাবতেই পারবে না এবং আমরা হচ্ছি জলের রাজা। তারা তখন ভারী কামান ও ট্যাংক নিয়ে চলতে পারবে না, জঙ্গি বিমান উড়াতে পারবে না। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী।
স্বাধীনতাযুদ্ধের নীতি-নির্ধারকদের মাঝে অন্যতম মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বীরউত্তম নৌ-কমান্ডোদের সাহসিকতা সম্পর্কে বলতেন, 'মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোদের অভিযান কেবল যে যুদ্ধে বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত করেছিল তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধকে ঐশ্বর্যমণ্ডিতও করেছে। বাংলার এ দামাল ছেলেরা শ্রেষ্ঠ বীরের মর্যাদার অধিকারী।'
'নিউইয়র্ক টাইমস'-এর দিল্লি সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ (আগরতলা, ভারত, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১) তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, '...বাঙালিরা নির্ভর করছে বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির ওপর, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যা শুরু হবে। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের জটিল পথ-গাঙ্গেয় ব্রহ্মপুত্র জলধারা ও সহস্রোত নদীর আঁকিবুঁকি-পশ্চিম প্রদেশের শুষ্ক ও পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগত পাঞ্জাবি ও পাঠানদের কাছে অপরিচিত। বর্ষায় যখন নদী ফুলে-ফেঁপে উঠবে এবং মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়বে, তখন এ অপরিচিতি আরও বাড়বে।'
বর্ষায় মুক্তিবাহিনীর প্রস্তুতির বিষয়ে এক বাঙালি কর্মকর্তা তাকে বলেন, 'আমরা এখন বর্ষার অপেক্ষায় রয়েছি...। তারা পানিকে এতো ভয় পায়, আপনি ভাবতেই পারবে না এবং আমরা হচ্ছি জলের রাজা। তারা তখন ভারী কামান ও ট্যাংক নিয়ে চলতে পারবে না, জঙ্গি বিমান উড়াতে পারবে না। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী।' (ডেটলাইন বাংলাদেশ: ১৯৭১, সিডনি শনবার্গ, অনুবাদ: মফিদুল হক)
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ৩ এপ্রিল ভারতের আগরতলার পত্রিকা 'দৈনিক সংবাদ' তাদের সম্পাদকীয়তে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পরাজয়ের সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ করে। পরাজয়ের অনেকগুলো কারণের মধ্যে বর্ষায় বৃষ্টির পানি ও নদ-নদী, খাল-বিল যে তাদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে তাও আলোচনায় আসে।
পত্রিকাটি লিখেছিল, '...আসন্ন বর্ষায় ওদের অবস্থা হবে আরও শোচনীয়। বাংলাদেশের নদী নালা খালে বিলে এখন পাঞ্জাবী সৈন্যের ডুবে মরা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে গেলেই তাদের মৃত্যু অনিবার্য।'
হয়েছেও তাই। বর্ষায় বৃষ্টির পানি ও বাংলার নদ-নদী পাকিস্তানিদের পরাজয় মানতে বাধ্য করে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর তীরের স্থাপিত নৌ-কমান্ডো ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা যোদ্ধারাই নয়, লাখো সাধারণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনী তাদের নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে নদীতে সংগঠিত যুদ্ধে জয়ী হয়েছে।
নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে বিশেষত বর্ষাকালে নদী ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করে মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় নদীগুলোও তাদের সহযোদ্ধা হয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
আগস্ট মাসে দেশের নদী বন্দরগুলোতে নৌ-কমান্ডোদের পরিচালিত অপারেশন 'জ্যাকপট', সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানিদের রসদবাহী জাহাজে হামলা এবং ডিসেম্বরে অপারেশন 'হটপ্যান্টস' তাদের নৌশক্তি বিধ্বস্ত করে দেয়।
দেশের জমিনে ছড়িয়ে থাকা অগণিত নদীতে সংগঠিত যুদ্ধ ছাড়াও সালদা নদীর যুদ্ধ, সুন্দরবনবেষ্টিত নদীগুলোতে সংগঠিত যুদ্ধগুলোই এর বড় প্রমাণ। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের বিজয় আসে নদী পথেও। ইতিহাসের বিচারে নদীই হয়ে ওঠে অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা। যে কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নিরূপণে নদীকে প্রাধান্য দিতে হবে। নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তা অত্যন্ত জরুরি।