পবিত্র রমজান মাস আসতে বাকি এখনও দুই মাসের বেশি। এরই মধ্যে রমজানে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে পরিচিত ছোলা, খেজুর, মটর ডাল ও চিনিসহ ছয় ধরনের পণ্য আমদানি শুরু হয়েছে। সামনে রমজান যত ঘনিয়ে আসবে ততই আমদানি বাড়বে। কোনও পণ্যের সংকট হবে না। দামও বাড়বে না।
আমদানিকারক ও ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার আগেভাগেই চিনিসহ ছয় ধরনের পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার বেড়েছে। কারণ, রমজানে এসব পণ্যের চাহিদা সাধারণত অনেক বেড়ে যায়। এজন্য আগেভাগেই পণ্যগুলো আমদানির ঋণপত্র খোলা বাড়িয়েছেন এবং চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি শুরু করেছেন। ব্যাংকে এলসি খোলায় বাংলাদেশ ব্যাংক আগের চেয়ে নমনীয় এবং ডলার সংকট কেটে যাওয়ায় নির্বিঘ্নে আমদানি করতে পারছেন বলেও জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।
বন্দরের আমদানিকারকরা বলছেন, এবার রমজানে ছোলা, খেজুর, মটর ডাল ও চিনিসহ ছয় ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে না। কারণ বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম কম থাকায় ক্রেতারা কম টাকায় কিনতে পারবেন। তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, না হয় সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কোনও কোনও পণ্যের ঋণপত্র খোলার হার ১১ থেকে ২৯৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ঋণপত্র খোলার পর পণ্য আসতে তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগে। সে অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির আগেই এসব পণ্য দেশে চলে আসবে। গত মাসে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে আরও বেশি পরিমাণ ঋণপত্র খোলা হয়েছে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ছোলা, খেজুর, মটর ডাল ও চিনির চাহিদা রমজানে বেড়ে যায়। বছরজুড়ে দেশে ছোলার চাহিদা থাকে দেড় লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানে পণ্যটির চাহিদা থাকে ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টন। বর্তমানে বিশ্ববাজারে পণ্যটি ৬০-৬২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে আমদানি খরচসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে পাইকারিতে ৭০-৭৫ টাকায় ক্রেতারা কিনতে পারবেন বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খেজুর আমদানি হয়েছে ছয় হাজার ৮৮৩ টন, মসুর ডাল ৪০ হাজার ২৬ টন, মটর ডাল (সব ধরনের) দুই লাখ ৪২ হাজার ৭৯ টন ও ছোলা ১১ হাজার ৬২৪ টন।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক এম এ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী দেবু মহাজন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার রমজানে নিত্যপণ্যের সংকট তো দূরের কথা বর্তমানে যে দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তার চেয়ে আরও কমে আসবে। বর্তমানে ছোলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। রমজানে ৭০-৭৫ টাকায় পাওয়া যাবে। কারণ এবার বিশ্ববাজারে দাম কম। পণ্য আমদানিতেও কোনও সংকট নেই। ইতিমধ্যে রোজার পণ্য আমদানি শুরু হয়েছে। আরও অনেক পণ্য আসার পথে আছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্য আমদানির এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে এবার সংকট হবে না। বরং দাম বর্তমানের চেয়ে আরও কমে আসবে।’
একই কথা বলেছেন আরেক আমদানিকারক মোহাম্মদ মহিউদ্দীন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদেশে ছোলার দাম কম। যে ছোলা দুই মাস আগে ৭০০ ডলার বুকিং ছিল, তা এখন বুকিং ৫০০ ডলারে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে রমজানে ছোলার দাম কোনোভাবেই বাড়বে না। একইভাবে গত বছরের চেয়ে এবার খেজুর, মটর ডাল ও চিনির দামও কম। চিনি গতবার এই সময়ে ১২০-১২৫ টাকা ছিল, এখন ১০০-১১০ টাকা।’
খাতুনগঞ্জের সালমা ট্রেডার্সের প্রতিনিধি জুয়েল মহাজন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে যে মটর ডাল ৭০-৮০ টাকা পাইকারিতে বিক্রি হতো তা এখন ৫০-৬০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। রমজানে দাম বাড়বে না।’
চিনির বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন মিলমালিকরা। তারাই ইচ্ছেমতো দাম বাড়াতেন এবং কমাতেন। এসব মিলমালিক ছাড়া অন্য কেউ চিনি আমদানি করতে পারতেন না। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চিনি আমদানি উন্মুক্ত করে দেয় সরকার।
যে কারণে নতুন করে অনেক ব্যবসায়ী আমদানি করছেন। ফলে ১৩০ টাকার চিনি ১০০ টাকায় নেমেছে। বর্তমানে স্টার শিপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের চিনি পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকা। আগামী রমজানেও এই দামে বিক্রি হবে। দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই।’
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের আওতায় ১৯টির মতো কারখানা আছে জানিয়ে আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘এর মধ্যে ৯ থেকে ১০টি কারখানা সচল আছে। এগুলো বছরে ৫০ হাজার টনের মতো লাল চিনি উৎপাদন করে। তবে সরকারি এই চিনি পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে ১২৫ টাকা কেজি দরে। যেগুলো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।’
রবিবার (০৭ ডিসেম্বর) খাতুনগঞ্জ বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি মণ সয়াবিন তেলের দাম ছয় হাজার ৮০০ টাকা এবং পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে পাঁচ হাজার ৮০০ টাকায়।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রমজান ঘিরে প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বেড়েছে। রমজানের বাকি আরও দুই মাসের বেশি। এ সময়ের মধ্যে আরও অনেক পণ্য আমদানি হবে। দিন যত ঘনিয়ে আসবে, আমদানি আরও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে চট্টগ্রাম দিয়ে খেজুর আমদানি হয়েছে ছয় হাজার ৮৮৩ টন। এর মধ্যে জুলাইয়ে ১৯৩ টন, আগস্টে ২৭৯ টন, সেপ্টেম্বরে এক হাজার ৮০৪ টন, অক্টোবরে দুই হাজার ৩৬৫ টন এবং ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ২৪২ টন।’