Image description

দেশের রাজনীতিতে যে তিনটি বড় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাঁকবদল ঘটেছে, সেগুলোর মাধ্যমে বেশি লাভবান হয়েছে বিএনপি। তিনটি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর, ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর এবং সবশেষ ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট। এসব অভ্যুত্থানের একটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন, দলটি একপর্যায়ে হয়ে ওঠে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল।

আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি প্রথমবার সরকার গঠন করে এবং সবশেষ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দলটির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় গত বছর। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, নানা কারণে গত দেড় বছরে তা কমে এসেছে। তবে এই সম্ভাবনা এখনো একেবারে হারিয়ে যায়নি।

গত বছরের ৫ই আগস্টের নাটকীয় পটপরিবর্তনের পর সেই ঘটনাপ্রবাহ বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে একটা বাঁকবদলের অবকাশ তৈরি করে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা বলেছিলেন, দেশের পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির ভালো ফল করার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকায় খালেদা জিয়ার দলই ভারতের জন্য ওই মুহূর্তে সেরা 'বাজি' হয়ে ওঠে।

অনেকে ধারণা করেন, অতীতের তিক্ততা দু'পক্ষই ভুলে গিয়ে ভারত ও বিএনপির মধ্যে নতুন সম্পর্কের দিকে যাত্রা শুরু হতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে এতে বিএনপির দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া মিললেও শেষ পর্যন্ত দলটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সেভাবে গড়ে উঠেনি। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি ও দলটির ইতিহাসে 'দুঃসহতম পরিস্থিতিতে'ও ভারতের সঙ্গে বিএনপি কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বরং, আওয়ামী লীগের প্রশ্নে এখনো ভারত আগের অবস্থানেই রয়েছে।

মা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতার মধ্যেও দেশে ফেরার বিষয়ে 'সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়' বলে গত ২৯শে নভেম্বর ফেসবুক স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেন ব্রিটেনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার এই মন্তব্য রাজনীতিতে আলোচনার ঝড় তুলেছে। কেন তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না এবং এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, এই প্রশ্ন উঠেছে।

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে তারেক রহমানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির বিষয়টি সামনে এসেছিল এবং যে যা-ই বলুন না কেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন না হলে তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কোন ভরসায়? দেশের রাজনীতি অনেকটাই নির্ভর করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার ওপরে। এর সূত্র ধরেই আলোচনায় আসছে বিএনপির প্রতি ভারতের এখন দৃষ্টিভঙ্গি, অবস্থানে এখনো তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করতে না পারার কথা। তারেক রহমানের দেশে ফিরতে বাধার বিষয়ে ভারতের সমর্থনের বিষয়টিও আলোচনায় আসছে।

 

নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও বিএনপি-ভারত, দু’পক্ষের মধ্যে আস্থা বা ভরসার সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি বলে দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্র ও বিশেষজ্ঞেরা সুখবর ডটকমকে জানিয়েছেন। গত বছর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব থেকে অনেকটাই সরে এসেছে, দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন উদ্যোগও নিয়েছে।

ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভারতের প্রতি বিএনপির মনোভাব বদলাচ্ছে কি না, দেশটি এখনো সে বিষয়ে নিশ্চিত নয়। কারণ, মনোভাব বদলানোর কোনো ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ এখনো দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্ক নীতিনির্ধারকদের কাছে নেই। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত জানানো হয়নি।

সূত্রমতে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ বিএনপি আসলেই ছাড়ছে কি না, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের আগে ও পরে তাদের জামায়াত-সঙ্গর চরিত্র কী হবে, তাও ভারতের অজানা। বিএনপির কয়েক নেতা যে কথা বলছেন ভারত সম্পর্কে, এর বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পাওয়াই দেশটির কাছে বড় কথা। এখনো সেই প্রমাণের ছিটেফোঁটাও ভারতের কাছে নেই।

সূত্রগুলোর দাবি, নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার আগে পর্যন্ত বিএনপি সম্পর্কে ভারতের মনোভাব পরিবর্তনের কোনো কারণ এখনো নেই। আগামী নির্বাচনে বিএনপি  জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ করছে কি না, ধর্মীয় মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তাদের ভূমিকা কী, ভারত এসব দিকে নজরে রাখছে। যদিও রাজনীতিতে এখন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দুরত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারেক রহমান আজ রোববারও (৭ই ডিসেম্বর) এক বক্তব্যে দলটির সমালোচনা করে বলেন, জামায়াতকে মানুষ ১৯৭১ সালে দেখেছে, তারা লাখ লাখ মানুষকে তখন হত্যা করেছে।

সুখবর ডটকমের অনুসন্ধান বলছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত প্রায় ১৬ মাসের বিভিন্ন সময়ে ভারতের ‘থিংক ট্যাংক’ বলে পরিচিত সংগঠনের কর্তারা ভারতীয়সহ পশ্চিমা প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোতে বিএনপির প্রতি ভারতের অবস্থানের মনোভাব  বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সরাসরি উপস্থিতি না থাকলেও বিএনপির প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন পরিবর্তন আসেনি।

ভারতের ‘থিংক ট্যাংক’ বলে পরিচিত সংগঠনগুলোর মধ্যে যেগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের মন্তব্য-বক্তব্য সুখবর ডটকম পর্যালোচনা করেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন (আরজিএফ), অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ), বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন (ভিআইএফ) ও ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ (আইডিএসএ)।

জানা গেছে, গত বছর আওয়ামী লীগের সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপি ভারতের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছে, দেশে ক্ষমতাসীন থাকার সময়ে ভারত সম্পর্কে বিএনপির মনোভাব যা ছিল, তা অতীত। ভারতবিরোধিতার যে সুর তাদের মধ্যে ছিল, তা ছিল ‘ভুল ও বোকামি’। অতীতের সেই ভুল শুধরে তারা নতুনভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়, যার ভিত্তি হবে ‘পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা’। তারা বিভিন্নভাবে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই তাদের এই পরিবর্তন। 

তারেক রহমান চান, ১৯৮০ ও ’৯০–এর দশককে পেছনে ফেলে নতুন ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে নতুনভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতে। বিএনপি চায়, ভারত নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করুক, কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে নয়। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তারেক রহমান নিজে ঠিক এই ধরনের কথাই বলেছিলেন। ঠিক এইভাবে ভারতকে আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তার দল যে ভূমিকা নিয়েছিল, এতে ভারতকে তারা বোকা বানিয়ে দিয়েছিল। ফলে ভারত এখন এ বিষয়ে বেশ সতর্ক।

ভারতের যারা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের ভালোমন্দের খবর রাখেন, তারা মনে করেন, ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা আদায় করতে হলে দল হিসেবে বিএনপিকে এখনো অনেক পথ হাঁটতে হবে। কারণ, তাদের শাসনকালে ভারতের অভিজ্ঞতা আদৌ সুখকর নয়। অবশ্য বিএনপি বরাবরই বলে আসছে, তারা ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’র বিরোধী। যে কোনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে দেখতে চায় দলটি। কিন্তু তাই বলে তাদের ভারত-বিরোধী বলে চিহ্নিত করার কোনো যুক্তি নেই।

২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি প্রথমবারের মতো ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, বিএনপির তরফে সম্পর্কের এই শীতলতা দূর করার একটা সক্রিয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সম্ভবত বিএনপির ধারণা ছিল, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রায় ঐতিহাসিক একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। তাদের শাসনের অবসানের পর দক্ষিণপন্থী বিজেপির সঙ্গে বিএনপির মধ্যে একটা নতুন সমীকরণের সূচনা হতে পারে। তবে তস হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতবিরোধিতা বিএনপির রাজনীতির একটি বড় অনুষঙ্গ। দলটির উদ্ভব, বিকাশ, নির্বাচনী কর্মকাণ্ড, এমনকি নিত্যদিনের রাজনৈতিক বিবৃতিতে এ বিরোধিতার উদাহরণ স্পষ্ট। বিএনপি তার প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে ভারতের কাছে নতজানু বলে বরাবরই কোণঠাসা করতে চেয়েছে। যদিও বর্তমানে দলটি ভারতবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সতর্কতা অবলম্বন করছে।

খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান তার ‘পলিটিক্যাল পার্টিস ইন বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন, কোনো সুনির্দিষ্ট এবং একক কোনো বৈশিষ্ট্যের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিকে পৃথক করা যায় তা হলো, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে দলটির ভারতবিরোধী মনোভাব। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটির ভিত্তিমূল ছিল এই বিরোধিতা।