সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে চুরি ঠেকাতে এর কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এক প্রকল্পেই ৬৮ কোটি টাকার পরামর্শক ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া প্রশিক্ষণ খাতে ৮ কোটি এবং সেমিনার বা কনফারেন্সের জন্য ৫ কোটি টাকা খরচের প্রস্তাবকে ব্যয়ের নয়ছয় ছক বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় এমন প্রকল্প নেওয়া কতটা যৌক্তিক, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ‘সোশ্যাল প্রটেকশন ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশন (এসপিডিটিসি)’ শীর্ষক প্রকল্পের এসব খরচের প্রস্তাব করা হয়। এটি নিয়ে বুধবার অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) সভা। পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠেয় ওই সভায় এসব ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বৈদেশিক ঋণ প্রকল্পে পরামর্শকের নামে অহেতুক ব্যয়ের বিষয়ে এর আগে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, বৈদেশিক ঋণ নিতে প্রয়োজন না হলেও অহেতুক পরামর্শক ব্যয় চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটা তাদের একধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। দেখা যায়, অনেক সময় অযোগ্য পরামর্শক এসে অহেতুক অফিস ভাড়া করে বসে বসে টাকা নিয়ে চলে যায়। এরপরও পরামর্শক রাখতে হয়। অনেক সময় ভালো পরামর্শকও থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় পরামর্শকের পেছনে ব্যয় করতে হয়। বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পে আমরা এই অপ্রয়োজনীয় পরামর্শকের বোঝা থেকে মুক্তি চাই।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবিত ‘সোশ্যাল প্রটেকশন ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশন (এসপিডিটিসি)’ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৭২ কোটি ৫৯ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ৯৭ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। প্রক্রিয়াকরণ শেষে অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে অর্থ বিভাগ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অবস্থান ও বরাদ্দের বিষয়ে বলা হয়েছে, ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রোগ্রামিং কমিটিতে অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখনো চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, কনসালট্যান্সি বা পরামর্শক খাতে যে ৬৮ কোটি টাকা ধরা হয়, এ ব্যয়ের যৌক্তিকতা এবং কোন ধরনের পরামর্শক (দেশি না বিদেশি), সে বিষয়ে প্রকল্প প্রস্তাবে কিছুই বলা হয়নি। এছাড়া গাড়ি ভাড়া খাতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা দিয়ে গাড়ি কেনা সম্ভব কি না, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। পাশাপাশি সেমিনার বা কনফারেন্স খাতে বৈদেশিক ঋণসহ ৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এ ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হবে। প্রশিক্ষণ খাতে ধরা হয়েছে ৮ কোটি টাকা। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইবে পরিকল্পনা কমিশন। এছাড়া আরও এক্সিট প্ল্যানসহ নানা বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়বেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি প্রকল্পটি গ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হবে বলে জানা গেছে।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন আল রশীদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এত টাকা পরামর্শক খাতে কেন প্রয়োজন, এর ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত। এগুলো সাধারণত বৈদেশিক ঋণ হলেও অহেতুক নিতে হয়। অনেক সময় বাধ্য হয়েই এমন পরামর্শক খাতের ব্যয় মেনে নিতে হয়। এক্ষেত্রে খরচ নয়ছয় করার সুযোগ থাকে। এজন্য যখন ঋণের আলাপ করা হয়, তখনই এ বিষয়ে কথা বলা উচিত। কেননা পরিকল্পনা কমিশনের কাছে যখন প্রকল্প প্রস্তাব আসে, ততদিনে ইআরডি হয়তো উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন শেষ করে ফেলে। এরপরও বিষয়গুলো অর্থ বিভাগ, ইআরডি এবং পরিকল্পনা কমিশন-সবারই খতিয়ে দেখা উচিত।
প্রকল্পটি গ্রহণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ডায়নামিক সোশ্যাল রেজিস্ট্রি বিকাশ, রক্ষণাবেক্ষণ, সমন্বয় এবং বাস্তবায়ন করা এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা। সামাজিক সুরক্ষা সুবিধাভোগী লক্ষ্যমাত্রা, নির্বাচন এবং পরিষেবা প্রদানে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা উন্নত করা, নাগরিক ও অংশীদারদের অভিযোগ মোকাবিলার জন্য একটি সিস্টেমভিত্তিক অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা চালু করা হবে। আরও আছে-গবেষণা পরিচালনা, সামাজিক সুরক্ষা তথ্য বিশ্লষণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং প্রকৃত গরিব মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। উন্নত লক্ষ্যমাত্রা, সম্প্রসারিত কাভারেজ, আন্তঃকার্যক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। এছাড়া লাইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় উন্নত করা, জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিতরণব্যবস্থা শক্তিশালী করতে নিরবচ্ছিন্ন তথ্য বিনিময় এবং একত্রীকরণে সক্ষম করা হবে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে রিয়েল-টাইম ড্যাশবোর্ড, স্বয়ংক্রিয় যাচাইকরণ এবং ম্যানুয়াল ত্রুটি কমানোর মাধ্যমে সুবিধাভোগী নির্বাচন করা। দুর্নীতি কমাতে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে একাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে অভিযোগ ট্র্যাক করার জন্য কার্যকরী এবং অ্যাকসেসযোগ্য সিস্টেম তৈরি। উন্নত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ভবিষ্যতের নীতি এবং প্রোগ্রাম ডিজাইন পরিচালনার জন্য ডেটা বিশ্লেষণ, ভিজুয়ালাইজেশন সরঞ্জাম এবং গবেষণা আউটপুট দিয়ে ডেটাচালিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সক্ষম করা। এক্ষেত্রে একক রেজিস্ট্রি, পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম এবং লাইন মন্ত্রণালয় সিস্টেম উন্নয়নসহ অবকাঠামো আপগ্রেড ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। পাশাপাশি কাঠামোগত প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে এমআইএস সিস্টেম পরিচালনার জন্য সরকারি কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে।