Image description
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঋণের উচ্চ সুদ বড় কারণ

বছরে ২০ লাখ লোক শ্রমবাজারে আসছেন। কিন্তু কর্মসংস্থান নেই। একের পর এক বন্ধ হচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান। একদিকে বিনিয়োগের জন্য চাহিদামাফিক টাকা নেই ব্যাংকে, অন্যদিকে ঋণের সুদের হারও ঊর্ধ্বমুখী। রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ চতুর্মুখী সংকটে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা একরকম দিশেহারা। ফলে বাড়ছে না নতুন বিনিয়োগ। চাহিদা ও ক্রেতা কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে শিল্পমালিকদের উৎপাদনের গতিতে লাগাম টানতে হচ্ছে। উপরন্তু পড়ে থাকছে উৎপাদিত পণ্য। অনেক ক্ষেত্রে দাম কমিয়েও বিক্রি করা যাচ্ছে না। এসব কারণে চরম এক দুঃসময় পার করতে হচ্ছে শিল্পোদ্যোক্তাসহ অধিকাংশ ব্যবসায়ীদের।

এসব কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। দক্ষ ও অদক্ষ মিলে লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও কাজ মিলছে না। সর্বশেষ এক জরিপ অনুযায়ী প্রায় এক কোটি মানুষ তাদের যোগ্যতা ও সম্ভাব্য কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরি পাচ্ছেন না। আবার কোথাও একটি পদ খালি হলে বিপরীতে আবেদন পড়ছে হাজার হাজার। যে কারণে প্রতিদিন দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই শিক্ষিত বেকার। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে বটে। তবু সুফল মিলছে না। এজন্য চাকরির বাজারে হাহাকার চলছে বললেও ভুল বলা হবে না। ফলে দারিদ্র্যের হারও বাড়ছে।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ ঝুঁকি ক্রমেই আরও বাড়ছে। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর মধ্যে রয়েছে-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, কাঁচামালের দামে ঊর্ধ্বমুখিতা এবং জ্বালানি সংকট অন্যতম। ফলে তারা বিনিয়োগে ভরসা পাচ্ছেন না।

জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন যুগান্তরকে বিনিয়োগ না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো দেশের অবকাঠামো সমস্যা। দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের অবকাঠামো বিনিয়োগের উপযোগী নয়। এরপর বর্তমানে সুদের হার খুব বেশি। এই হারে সুদ দিয়ে নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, বর্তমান ফ্যাক্টরিগুলো চালিয়ে রাখা কঠিন। তিনি বলেন, নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে নতুন বিনিয়োগও আসছে না। মীর নাসির আরও বলেন, বিনিয়োগ না হওয়ার আরেক কারণ হলো বর্তমানে একটি ট্রানজিশনের (রূপান্তর) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। সামনে নির্বাচন। এই নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকার আসবে। আর মানুষ অপেক্ষা করছে, ওই সরকারের পলিসি কী হয়। সেই পলিসির ওপর ভিত্তি করে তারা নতুন করে বিনিয়োগ করবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ অবস্থার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেশি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে হারে ঋণের সুদ নেওয়া হচ্ছে, তা এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। এই হারে সুদ দিয়ে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আসার কথা নয়। ফলে সুদের হার কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। এটি বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, ভালো নির্বাচন হলে আশা করছি পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। তখন নতুন বিনিয়োগ আসবে। তবে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এর আগে বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়া হয়েছিল, ইতোমধ্যে তার সুদ পরিশোধ শুরু হয়েছে। বর্তমানে ঋণ ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ভবিষ্যতে এই ঋণ অর্থনীতিতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। আর অর্থনীতিতে সমস্যা হলে অন্যান্য সূচকেও এর প্রভাব পড়বে।

সরেজমিন যা দেখা গেল : পল্লবী, মিরপুর-১ ও কমলাপুরসহ রাজধানীর অন্তত ২৫টি জায়গায় প্রতিদিনই শ্রমিকের হাট বসে। কাজের জন্য শ্রমিকরা এখানে জড়ো হন। একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি দেওয়ার জন্য এসব স্পটে ভিড় করেন। চাহিদা অনুসারে এখান থেকে বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ কাজসহ নানা কাজের জন্য আগ্রহীরা নিয়ে যান। কিন্তু গত কিছুদিন থেকে এসব স্পটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও তারা কাজ পাচ্ছেন না। গত ৩ দিন সরেজমিন গিয়ে অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। পল্লবীতে গিয়ে কথা হয় মধ্যবয়সি রমজান আলীর সঙ্গে। তিনি একটি কোদাল হাতে বসে আছেন। সকাল তখন প্রায় ১০টা। কিন্তু তিনি কোনো কাজ পাননি। এ রকম অনেককে বসে থাকতে দেখা যায়। তারা বলেন, আগে সকাল ৮টার মধ্যে তারা কাজ পেতেন। এখন কাজ পাচ্ছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে। সরকারি হিসাবে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শ্রমিক। এই শ্রমিকের ওপর ভিত্তি করেই শক্তিশালী হচ্ছে অর্থনীতি। কিন্তু শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেই।

বেকারত্ব বাড়ার আরও কারণ : শিক্ষিত বেকারদের অবস্থা বড়ই নিদারুণ। এমনিতে দেশে সেভাবে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলেও তাদের বেশির ভাগ সার্টিফিকেট নির্ভর। চাকরিদাতাদের কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ‘ফেক আইডেন্টিটি’ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ। অথচ এরা সত্যিকারার্থে দক্ষ হলে দেশে চাকরির সুযোগ না থাকলেও বিশ্ববাজারে কাজের অভাব নেই।

দেশের প্রথম সারির শিল্প গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের শীর্ষ পদে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এমনিতে এখন চাকরি বাজার সংকুচিত হয়ে গেছে। তারপরেও যখন কোনো লোক নিয়োগ দিতে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়-তখন যারা আবেদন করেন তাদের ৯০ ভাগ থাকেন আনফিট। অথচ বাস্তবে তাদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন। তারা বলেন, দেশে ও বিদেশের চাকরি বাজারকে প্রাধান্য দিয়ে লেখাপড়ার সিলেবাস প্রস্তুত করতে হবে। তা না হলে এসব শিক্ষিত বেকার জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া সবাই তো চাকরির সুযোগ পাবে না। ফলে লেখাপড়া শেষ করে তারা যাতে নিজেরা কিছু করতে পারেন-সেজন্য লেখাপড়ার সিলেবাসকে সেভাবে ঢেলে সাজাতে হবে।

যেসব সূচক নিম্নগামী : চারটি সূচক দিয়ে একটি দেশের বিনিয়োগের পরিস্থিতি বোঝা যায়। এরমধ্যে রয়েছে-বিনিয়োগ নিবন্ধন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি এবং বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ। বতর্মানে এর সবগুলোই নেতিবাচক বা নিম্নগামী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি (ঋণপত্র) নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি ১১ শতাংশ কমেছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১১৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার। একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৯ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। অন্যদিকে গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সময় সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৬১ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর বর্তমানে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ২৭ দশমিক ২২ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতের ঋণ কমে হয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। এছাড়াও কমে আসছে বেসরকারি বিনিয়োগের নিবন্ধন। এ পরিস্থিতিতে দেশের স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার সংলাপ করে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সেখানে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিনিয়োগে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বাধার কথা বলা হয়। এগুলো হলো-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, বিদ্যুতের দাম বেশি, নতুন করে গ্যাসের সরবরাহ না থাকা, ব্যাংক ঋণের অতিরিক্ত সুদ, উচ্চ কর, পরিবহণ সমস্যা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সংলাপে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে করকে সন্ত্রাস হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

যা বলছে বিবিএস : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের শ্রমশক্তির যে জরিপ করেছে, তা এই সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করেই। বিবিএসের হিসাবে ২০২৪ সাল শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। এর মধ্যে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা ৮ লাখ ৮৫ হাজার। ২০২৩ সালে বেকারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৫ লাখ। আলোচ্য সময়ে দেশের শ্রমশক্তি ছিল ৫ কোটি ৮৯ লাখ নারী-পুরুষ। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার এবং নারী ১ কোটি ১৪ লাখ ৪০ হাজার। বিবিএসের সংজ্ঞা অনুসারে, কর্মক্ষম জনসংখ্যার মধ্যে যারা সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা মজুরি বা পারিবারিক কাজে নিযুক্ত থাকেন, তাদের কর্মে নিয়োজিত ধরা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এক ঘণ্টার কাজ জীবিকা নির্বাহের জন্য যুক্তিসঙ্গত নয়।

ফলে ওই জরিপেই বলা হয়েছে, প্রায় এক কোটি মানুষ তাদের যোগ্যতা ও সম্ভাব্য কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরি পাচ্ছেন না। অর্থাৎ এই মানুষগুলো বেকার। অন্যদিকে যারা কর্মে নিয়োজিত নন; কিন্তু বেকার হিসাবেও বিবেচিত নন, তারাই মূলত শ্রমশক্তির বাইরের জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীতে এর মধ্যে শিক্ষার্থী, অসুস্থ ব্যক্তি, বয়স্ক, কাজ করতে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মে নিয়োজিত নন এমন গৃহিণীরা। ডিসেম্বর শেষে দেশে এমন ৬ কোটি ২৮ লাখ ১০ হাজার নারী-পুরুষ ছিলেন।