আগামী বছর শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ, সার ও বাসাবাড়িতে কী পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে, তা এখনো ঠিক করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি কাজ করলেও গ্যাস সরবরাহের হিসাব মেলাতে পারছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই গ্যাসের মারাত্মক সংকট চলছে। ২০২৬ সালে উৎপাদন কমতে পারে দৈনিক কমপেক্ষ দেড় কোটি ঘনফুট। বিশেষ করে মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরনের সবকটি ফিল্ডে (ক্ষেত্র) দৈনিক উৎপাদন কমছে ৫ লাখ ঘনফুট। অন্যদিকে সরকারি ক্ষেত্রেও গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছর শিল্পকারখানার জন্য সংকট অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন শিল্প-মালিক ও ব্যবসায়ীরা। দেশে এখন গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুটেরও বেশি। কিন্তু সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুট। কখনো কখনো এই সরবরাহ আরও কমে যায়।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৫ ডিসেম্বর দেশে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ২৬৭ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি ৮৯ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট। এ সরবরাহই ২০২৬ সালে আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ২০২৬ সালে কী পরিমাণ গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হবে, তার সব নিশ্চয়তাপত্র এখনো সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানির কাছে দেওয়া হয়নি। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান ৩ ডিসেম্বর যুগান্তরকে বলেছিলেন, ‘২০২৬ সালে কী পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ দিতে পারব, আশা করা যায় ৮-৯ দিনের মধ্যে তা চূড়ান্ত করা যাবে। কারণ, তখন দেশের বিভিন্ন কূপে সংস্কারকাজ শেষ হবে।’
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, গ্যাস সংকটের বিষয়টি ব্যবসায়ী কমিউনিটির জন্য গভীর চিন্তার। দেশে প্রতিনিয়ত গ্যাসের উপাদন এবং সরবরাহ কমছে। বিপরীতে তেমন কোনো বড় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। গত সপ্তাহেও বিটিএমএ-এর পক্ষ থেকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে। তার মতে, একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত পোশাক খাতেও বড় ক্রয় আদেশ আসছে না। কূপ খননেও বিদেশি কোনো কোম্পানি আসছে না। শিল্প কীভাবে বাঁচবে, এর কোনো চিন্তা নেই তিতাসেরও।
জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী নির্বাচিত সরকার সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে গ্যাস খাত নিয়ে। কারণ, নতুন সংযোগের চাপের মধ্যে কমতে থাকবে গ্যাসের উৎপাদন। পেট্রোবাংলার হিসাবে ২০২৬ সালের জুলাই পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি ভালো থাকলেও শেষের দিকে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, শেভরনের বিবিয়ানা ক্ষেত্রসহ অন্য ৫টি ক্ষেত্রে গ্যাসের উৎপাদন কমার আশঙ্কা।
এদিকে জ্বালানি বিভাগ জানিয়েছে, গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে সারা দেশে ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সব কূপ সফলভাবে খনন সম্পন্ন করতে পারলে ২০২৬ সালের মধ্যে গ্যাস আসার কথা ৬৪ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট। তবে এখনো বেশির ভাগ কূপ খননের কাজ শুরু হয়নি। এর মধ্যে শুধু রশিদপুর-৩ নম্বর কূপ থেকে ৮০ লাখ ঘনফুট এবং হবিগঞ্জ-৫ নম্বর কূপ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। সামনে আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে তা এখন বলা যাবে না-এমনটি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২৬ সালে গ্যাসের সরবরাহ এবং কোন খাতে কত বরাদ্দ দেওয়া হবে, তা নিয়ে গত মাসে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশনস) রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। কমিটির প্রধান রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ২০২৬ সালে গ্যাস উৎপাদন আরও কমবে। সরবরাহ ঠিক রাখা কঠিন। তাই কোন খাতে কত দেওয়া হবে, এর হিসাব করাও কঠিন। তিনি জানান, এ সপ্তাহের মধ্যে ২০২৬ সালে গ্যাসের সরবরাহ দেওয়ার পরিকল্পনা রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে। সবকিছু বিবেচনা করে বিদ্যুতে গ্যাসের সরবরাহ আগামী বছর কমাতে হবে। তবে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ কমানো হবে না। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানও একই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, শিল্প ঠিক রেখে অন্য জায়গায় কমানো যায় কি না, তা ভেবে দেখা হচ্ছে।
দেশে এখন গ্যাস ক্ষেত্র আছে ২১টি। এর মধ্যে একেবারে বন্ধ রূপগঞ্জের ক্ষেত্রটি। পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, আগামী বছর বাংলাদেশ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দৈনিক গড়ে গ্যাস পাওয়া যাবে ৫২ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট, সিলেট গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ১৬ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট, বাপেক্সের ক্ষেত্র থেকে ১২ কোটি ৯০ লাখ ঘনফুট, শেভরনের ক্ষেত্র থেকে ৯০ কোটি ৩ লাখ ঘনফুট, তাল্লুর ক্ষেত্র থেকে ৩ কোটি ঘনফুট এবং আমদানি হবে ৯৫ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাস।
আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে শেভরনের ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ৯৭ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট পাওয়া গেলেও ডিসেম্বরে গিয়ে এটি ঠেকবে ৮২ কোটি ৯ লাখে। তবে মেরামত প্রকল্পের আওয়ায় সরকারি ক্ষেত্রে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। সরকারি তিনটি কোম্পানি ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে ৭৫ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট সরবরাহ দিলেও ডিসেম্বরে গিয়ে দাঁড়াবে দৈনিক ৮৮ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট। সব মিলিয়ে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে ২৬৮ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট দৈনিক সরবরাহ দিলেও ডিসেম্বরে গিয়ে কমে দাঁড়াবে ২৫৭ কোটি ৯ লাখ ঘনফুট।
সরবরাহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, আগামী বছর এপ্রিল এবং মে মাসে অর্থাৎ গরম মৌসুমে গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ খাতে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হলেও অক্টোবরে এ খাতে গ্যাস সরবরাহ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী বছর মার্চ থেকে পরবর্তী তিন মাস কয়েকটি সার কারখানা বন্ধ হতে পারে। তখন গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হবে ২৫ কোটির পরিবর্তে দৈনিক ১৬ থেকে ১৭ কোটি ঘনফুট। তবে শিল্পে সারা বছর ৫৭ কোটি ৭০ লাখ এবং ক্যাপটিভে দৈনিক ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দৈনিক ৯০ কোটি ঘনফুটের বেশি আমদানি করা গ্যাস সরবরাহ করে পেট্রোবাংলা। এর জন্য বছরে ব্যয় হয় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এবার ১১৫টি কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকার টু সরকার (জি টু জি) আওতায় ৫টি দেশ থেকে ৯৮টি কার্গো আসতে পারে। বাকি ১৭টি কার্গো কেনা হবে স্পট মার্কেট থেকে। তবে (জি-টু-জি) এর আওতায় ৯৮টি কার্গোর নিশ্চয়তাপত্রের বেশির ভাগই এখনো দেওয়া হয়নি।
এর মধ্যে শুধু ওমান গ্যাসকে এসবিএলসি (স্টান্ডার্ড লেটার অব ক্রেডিট) দেওয়া হয়েছে। কাতারের রাজ গ্যাসের জন্য এইচএসবিসি ১৯৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিতে রাজি হলেও এখনো দেওয়া হয়নি এসবিএলসি। ডিসেম্বরের মধ্যে সরবরাহকারীদের কেনার নিশ্চয়তা দিতে না পারলে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।