আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে পাল্টে যাচ্ছে জোটের হিসাবনিকাশ। বিশেষ করে বিএনপি প্রথম দফায় ২৩৭ আসনে দলীয় সম্ভাব্য মনোনয়ন ঘোষণার পর শরিক দলগুলো আশা করেছিল ৬৩ আসনের বেশির ভাগই তাদের ছাড় দেবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার আরও ৩৬ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। এসব আসনের বেশ কয়েকটিতে শরিক দলগুলো প্রচারণা চালাচ্ছে। শরিকদের জন্য এখনো কোনো আসনই আনুষ্ঠানিক ছাড় দেয়নি বিএনপি। বিএনপির এমন সিদ্ধান্তে শরিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেসব দল একসঙ্গে মাঠে ছিল তাদের নিয়ে বিএনপির একযোগে ভোট করা অসম্ভব হয়ে উঠছে।
এ অবস্থায় দীর্ঘদিনের শরিক দলগুলো বিএনপিবিরোধী প্ল্যাটফর্ম জামায়াতের সঙ্গে ভোট করার ঘোষণা দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করলেও আটটি দলের পক্ষে একক প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। ১০০ আসনে শরিকদের ছাড় দেওয়ার কথা বলছে দলটি। বিএনপি থেকে আসন ছাড়ের নিশ্চয়তা না পেয়ে অনেক দল জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। এ ছাড়াও বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে নিত্যনতুন নির্বাচনি জোট গঠন হচ্ছে। সব মিলিয়ে জোটের হিসাবে শুরু হয়েছে গোলমাল।
বিএনপি জোটে টানাপোড়েন : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে- এমন আভাস পেয়ে বিএনপি নিজেদের কৌশল বদলিয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে আসন বণ্টন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১০-১২টি আসন মিত্র কিংবা সমমনা দলগুলোর জন্য ছেড়ে বাকি সব আসনেই দলীয় প্রার্থী দিতে পারে বিএনপি। এসব দলকে নিয়ে জোটবদ্ধ নির্বাচন হবে, নাকি আসনভিত্তিক সমঝোতা হবে- তাও এখনো চূড়ান্ত করেনি বিএনপি। তারা বলছেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন ও সরকার গঠনের যে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২৭২টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা হয়েছে।
বিএনপির সঙ্গে ২০ বছরের সম্পর্ক অবসানের ঘোষণা দেয় লেবার পার্টি। ক্ষোভ প্রকাশ করে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, বিএনপি সমমনাদের সঙ্গে বসে আলোচনা না করেই নিজেদের মতো প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এতে জোটবদ্ধ নির্বাচন নিয়ে স্পষ্টতা কমে গেছে এবং বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বিএনপি এককভাবে প্রার্থী ঘোষণা করায় জোট ও সমমনাদের মধ্যে অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। আমরা মনে করছি, এটি বিএনপির আগের ঘোষণার ব্যত্যয়। এতে করে দুর্দিনের বন্ধুদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব বাড়ছে। জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা এখনো ২৮টি আসন বাকি রেখেছি। তাছাড়া যেসব আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে, তা চূড়ান্ত নয়। সময় রয়েছে সামনে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করি আমরা।
১২-দলীয় জোটপ্রধান জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার খিলগাঁও কার্যালয়ে শুক্রবার মনোনয়ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। আলোচনায় বিএনপি তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে প্রার্থী ঘোষণায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হন। এ বিষয়ে ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও করণীয় সম্পর্কে কাল সোমবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জোটের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করা হবে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, নির্বাচনি সমঝোতার প্রশ্নে আলোচনা শুরু হয়েও থেমে আছে। সে জন্যই ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আলোচনার মাধ্যমেই এগুলোর নিষ্পত্তি হবে। জানা গেছে, ঢাকা-১৭ আসনে আন্দালিভ রহমান পার্থ, ঢাকা-১৩ আসনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে জোনায়েদ সাকি এবং বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বিএনপির সমর্থন পেতে পারেন। এর বাইরে পিরোজপুর, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ, ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীতে একটি করে আসনে সমমনা কয়েকটি দলের নেতারা বিএনপির সমর্থন পাবেন বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। দলীয় নেতাদের দেওয়া এসব তথ্যমতে, নিজস্ব প্রতীকে রাজপথে থাকা দলগুলোর নিজস্ব প্রতীকে ভোট করে বিজয়ী হওয়া অসম্ভব। বিএনপির সমর্থন পেয়ে প্রার্থী হতে পারেন কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মধ্যেই। অন্যভাবে তাদের মূল্যায়ন করতে চায় বিএনপি। বৃহৎ ঐক্য গড়ছে জামায়াত : ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও নির্বাচন সামনে রেখে বৃহৎ মোর্চা গঠন করছে জামায়াত। পূর্বঘোষিত তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারেন ৮০ থেকে ১০০ প্রার্থী। ৫ দফা দাবিতে চলমান যুগপৎ আন্দোলনে শরিক অপর ৭টি দলের জন্য এসব আসন ছাড় দেবে জামায়াত। সূত্র বলছে, নানা শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং নিজ দলের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের ভিত্তিতে এসব প্রার্থী বদল করা হবে। জামায়াতের প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের বলছে, সংখ্যার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগি নয়। জামায়াতসহ ৮ দলের নেতারা একমত যে, যাকে যেখানে দিলে বিজয়ী হতে পারবেন, তাকে সেখানে প্রার্থী করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ইসলামি দলগুলোর সব ভোট এক বাক্সে’ আনাই দলগুলোর টার্গেট। এরই অংশ হিসেবে একক প্রার্থী ঠিক করতে কাজ করছে ৮টি ইসলামি দল। এ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি দলগুলো মাঠপর্যায়ে নিজেদের প্রার্থীর জনপ্রিয়তা নিয়েও জরিপ করছে। চলমান বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি শেষ হলে ৮ দলের লিয়াজোঁ কমিটি আলোচনা করে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলনসহ ৮ দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, কোন দল কত আসনে নির্বাচনে আগ্রহী বা বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বা কতটুকু, সেটি মাঠ জরিপের রিপোর্টেই পরিষ্কার এবং এর ভিত্তিতেই তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। তবে কোন দলকে কত আসন দেওয়া হবে, তা নিয়ে কিছুটা জটিলতা রয়েছে। ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে সব দলের নেতারাই সর্বোচ্চ ছাড়ের মানসিকতার কথা জানিয়েছেন। ইসলামি দলগুলো সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়ে আসুক, এটাই টার্গেট। ৮ দলে শীর্ষ নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে কীভাবে সবাইকে পাস করিয়ে আনা যায়।
বিএনপি ও জামায়াতের বাইরেও নির্বাচন ঘিরে যুগপৎভাবে ভোট করবে এনসিপি। ৯ বামপন্থি দল একসঙ্গে ভোট করার ঘোষণা দিয়েছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি-জেপি ও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটবে সোমবার। সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ১৫-দলীয় প্রগতিশীল ইসলামি জোট পুনর্গঠন হচ্ছে। শুক্রবার মানবতার জোট নামে ১৫ দলীয় জোটের ঘোষণা দিয়েছেন ন্যাশনাল কংগ্রেস বাংলাদেশ চেয়ারম্যান কাজী সাব্বির।