Image description

দেশের অন্যতম অপরাধপ্রবণ জেলা ঝিনাইদহ আবারো আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১৫ মাসে এই জেলায় অন্তত ৭০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। হঠাৎ করে খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে সাধারণ মানুষের। সামাজিক আধিপত্য বিস্তার, মাদক-সংশ্লিষ্ট বিরোধ ও চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে।

সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর রাতে ঝিনাইদহ শহরতলীর পবহাটি এলাকার একটি বাড়ি থেকে সাইমা আক্তার নামের চার বছর বয়সী শিশুর গলাকাটা বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায়, এদিন সকালে খেলা করতে প্রতিবেশী শান্তনা খাতুনের বাড়িতে যায় শিশু সাইমা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে থানায় জিডি করে বাবা সাইদুল। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই সাইমার গলাকাটা বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে করে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েই চলেছে। বিচারহীনতার কারণে হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ হঠাৎ করেই বেড়েছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তুচ্ছ ঘটনায় মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে ।

এ জন্য সামাজিক অবক্ষয়কে দায়ী করছেন তারা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা কারণে সম্প্রতি হত্যার ঘটনা বেড়েছে। তবে প্রশাসন হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও রহস্য উদঘাটনেও কাজ করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ ডিসেম্বর ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ চিনিকলের মাঠের পেছনে ওমর আলী নামের এক নসিমন চালককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৯ নভেম্বর দুপুরে ঝিনাইদহ শহরতলীর পবহাটি এলাকায় দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে মুরাদ হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

১৫ নভেম্বর বিকেলে নেশার টাকা না পেয়ে নারগিস আক্তারকে হাটুড়িপেটা করে হত্যা করে তারই ছেলে। ১৪ নভেম্বর সদর উপজেলার কম্বোডিয়া প্রবাসী মাহবুবুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করার হয়। ৩০ অক্টোবর সদর উপজেলার রাঙ্গিায়ারপোতা গ্রামে ইসহাক আলী নামের এক কৃষকের হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। ৮ নভেম্বর কালীগঞ্জের পুকুরিয়া গ্রাম থেকে অজ্ঞাত এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একইদিন দিনে হরিণাকুণ্ডুর বাকচুয়া গ্রামের পানক্ষেত থেকে সখিরন নেছা নামের এক নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ২৬ অক্টোবর শৈলকুপার পাইকপাড়া গ্রামে বিলকিস বেগম নামের এক নারীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২১ অক্টোবর রাতে শৈলকুপার কামান্না গ্রামে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মিন্টু বিশ্বাস নামের এক কৃষক নিহত হয়। ১০ অক্টোবর ঝিনাইদহ শহরতলীর গোপনাথপুর এলাকায় তাছলিমা খাতুন নামের এক নারীর বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঝিনাইদহের ছয় উপজেলাতে ৭০ জন ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শৈলকুপা থানায় ৯ জন, সদরে ২৩ জন, কালীগঞ্জে ১০ জন, হরিণাকুণ্ডুতে ৯ জন, কোটচাঁদপুরে ৮ জন ও মহেশপুরে ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৯ জন, প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত ৫ জন, কুপিয়ে হত্যার শিকার ২১ জন, ছুরিকাঘাতে নিহত ৯ জন, শ্বাসরোধে হত্যার শিকার হয়েছেন ১২ জন। এছাড়া জেলার ছয়টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে অজ্ঞাত ৪ ব্যক্তিকে দাফন করে প্রশাসন। 

জেলা সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও মানবাধিকার কর্মী আনোয়ারুজ্জামান আজাদ বলেন, ‘বর্তমানে ঝিনাইদহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ আগের মতো আর কাজ করতে পারছে না। ফলে অনেকে এখন সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হতে ভয় পাচ্ছে। দিনের বেলায় সাধারণ মানুষ একা চলতে ভয় পাচ্ছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরো কঠোর না হলে এসব ঘটনা থামবে না।’

মাওলানা ভাসানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অপরাধ বিশ্লেষক মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘বিচারহীনতার কারণে এসব ঘটনা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক দুর্বল হওয়া, নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। ফলে একে অপরকে খুন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমেও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এছাড়াও গত বছরের ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন ধরে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। যত দ্রুত পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় করা যাবে ততই এসব ঘটনা কমে আসবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ নজর দেওয়া উচিত।’

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা রকম অস্থিরতার কারণে সম্প্রতি হত্যার ঘটনা বেড়েছে। পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছে। একই সঙ্গে হত্যার রহস্য উদঘাটনে কাজ করে যাচ্ছে। শুধুমাত্র পুলিশ প্রশাসন কঠোর হলেই এসব অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে না। এ জন্য সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’ 

তিনি আরো বলেন, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে নিয়ে আমরা বিট পুলিশিং এর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করছি। আশা করছি শিগগিরই এ ধরণের অপরাধ কমে আসবে।’