Image description
৫ আগস্ট থেকে স্বামী সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচিত টানা চারবারের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে আছেন। রাজধানী ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় আত্মগোপনে আছেন তিনি।

স্বামী ফার্মাসিউটিক্যাল কনসালট্যান্ট সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইন এবং ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড কলেজের আই.বি কোর্সে অধ্যয়নরত ছোট ছেলে সৈয়দ ইবতেশাম রফিক হোসাইন তার সঙ্গে আছেন। দুই সন্তানের মা ড. শিরীন শারমিনের বড় মেয়ে লামিসা শিরীন হোসাইন যুক্তরাষ্ট্রে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট পদে চাকরি করছেন। বড় মেয়ে ছাড়া বাকি সবাই এক ছাদের নিচে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতেই আছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। ওইদিন দুপুরেই একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে কোনো ধরনের প্রটোকল ছাড়াই স্বামী ও সন্তান নিয়ে সংসদ ভবনস্থ বাসভবন থেকে বের হয়ে আত্মগোপনে চলে যান ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

এই ঘটনার ২৭ দিনের মাথায় গত ২ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাত স্থান থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি। ওইদিনই তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে দেওয়া গেজেটে বলা হয়, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৪(২)(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্পিকারের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তার পদত্যাগপত্রটি রাষ্ট্রপতি আজ গ্রহণ করেছেন এবং আজই তা কার্যকর হয়েছে।’ সংবিধানের ৭৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের পদ কখন শূন্য হয়।

সেখানে উল্লেখ আছে, স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকার রাষ্ট্রপতির কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করলে তাদের পদ শূন্য হবে। একইভাবে নতুন স্পিকার নিয়োগের বিধান আছে সংবিধানের ৭৪(১) অনুচ্ছেদে। সেখানে বলা আছে, ‘স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার পদের যে কোনোটি শূন্য হলে সাত দিনের মধ্যে কিংবা ওই সময়ে সংসদ বৈঠকরত না থাকলে পরবর্তী প্রথম বৈঠকে তা পূর্ণ করার জন্য সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করতে হবে।’

তবে এখন যেহেতু সংসদই নেই, ফলে সাত দিনের বাধ্যবাধকতা এখানে প্রযোজ্য হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে পরবর্তী সংসদ বসলে তখনই নতুন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের সুযোগ আসবে।

নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো সংসদের প্রথম বৈঠক শুরু হয় আগের সংসদের স্পিকারের সভাপতিত্বে। নব্বইয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের বিদায়ের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদের প্রথম বৈঠকে আগের সংসদের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরীকে নিয়ে আপত্তি ওঠে। তবে শেষমেশ নিয়ম মেনে তার সভাপতিত্বেই সংসদ অধিবেশন শুরু হয়।

সংবিধান অনুযায়ী নতুন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করে দিয়ে তিনি বিদায় নেন। একইভাবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোট করেও আন্দোলনের কারণে বিএনপি সরকার টিকতে না পারার পরও সপ্তম সংসদের প্রথম অধিবেশন ষষ্ঠ সংসদের স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর সভাপতিত্বে শুরু হয়। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, ড. শিরীন শারমিন বিদায় নেওয়ায় আগামীতে যে সংসদ গঠিত হবে, তা কার সভাপতিত্বে শুরু হবে।

এ বিষয়েও সংবিধানের ৭৪ অনুচ্ছেদের ৬ নম্বর ধারায় বলা আছে, অনুচ্ছেদের (২) দফার (পদ শূন্য হওয়া সংক্রান্ত) বিধানাবলি সত্ত্বেও ক্ষেত্রমতো স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে। যার অর্থ দাঁড়ায়, পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া এবং তা গ্রহণ করা সত্ত্বে¡ও পরবর্তী স্পিকারের কাছে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দেওয়া অবধি ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, পরবর্তী সংসদ না আসা পর্যন্ত স্পিকার তার পদে বহাল থাকেন।

সংরক্ষিত নারী আসন থেকে ২০০৯ সালে প্রথম সংসদে যাওয়া ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী টানা চতুর্থবার আইনসভার প্রধান বা স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রথম নারী হিসাবে বাংলাদেশের সংসদের স্পিকারের চেয়ারে বসে ইতিহাসের অংশ তিনি। পদত্যাগের পর এর মধ্যে একবার আলোচনায় আসেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ৩ অক্টোবর স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইনসহ ঢাকার আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসে সাধারণ ই-পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন তিনি। পরে সেখানে না গিয়ে গত ১০ অক্টোবর ঘরে বসে তাদের আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

অথচ ই-পাসপোর্ট আবেদনের নিয়মে বলা আছে, সবকিছু ঘরে বসে করতে পারলেও নির্ধারিত তারিখে অসুস্থ এবং যারা শারীরিকভাবে অক্ষম, তারা ছাড়া আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দিতে আবেদনকারীকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, অদৃশ্য মহলের ইশারায় ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর বেলায় এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে।

যদিও এসব ঘটনা ছাপিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে একটি প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছেন-এ নিয়ে নানা মহলে কৌতূহল কাজ করছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছে।

গত ২৭ আগস্ট স্বর্ণশ্রমিক মুসলিম উদ্দিনকে হত্যার অভিযোগে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। রংপুর শহরের পূর্ব গণেশপুর এলাকার বাসিন্দা মুসলিম উদ্দিনের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি আমলি আদালতে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলাটি তদন্ত করছে রংপুর মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এ বিষয়ে আরএমপির উপকমিশনার (ক্রাইম) শিবলী কায়সার বলেন, ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী হত্যা মামলার পলাতক আসামি। পুলিশ তাকে খুঁজছে, সন্ধান পেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে।

স্পিকারের বাসভবনের দায়িত্বে সংসদ সচিবালয়ের একাধিক কর্মচারী নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, ৫ আগস্ট বেলা দেড়টার দিকে সংসদ ভবন এলাকায় নিজের সরকারি বাসভবন থেকে বেরিয়ে যান ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্পিকারের জন্য বরাদ্দ গাড়ি ব্যবহার না করে একটি সাধারণ প্রাইভেট কারে করে সপরিবারে তড়িঘড়ি বের হন তিনি।

সংসদ সচিবালয়ের পরিবহণ পুল থেকে গাড়ি পাঠানো হলেও ওই গাড়ি ব্যবহার করেননি ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। গাড়িতে কয়েকটি লাগেজ ছিল বলে জানান স্পিকারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন স্বামী ও ছেলে। তবে সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে তিনি কোথায় গেছেন তা জানা নেই তাদের।

ওই ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর জানাজানি হওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধরা জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকে হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালায়। এ থেকে রেহাই পায়নি স্পিকারের বাসভবনেও। সেখানে গ্যারেজে থাকা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তালাবদ্ধ দরজা ভেঙে বিক্ষুব্ধরা ঢুকে পড়ে স্পিকারের বাসভবনে। সেখানে ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাটও চালানো হয়।