Image description
অন্তর্বর্তী সরকারের ষোলো মাস

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ষোলো মাসে দেশের ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, গুরুত্বপূর্ণ বিচার ও সংস্কারকাজ, প্রবাসীদের কল্যাণ ও তাদের ভোটাধিকার প্রদানসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভালো কাজ করেছে। পরিকল্পনামাফিক কাজগুলো বাস্তবায়নে এ সময়ে সরকারের পূর্ণ সদিচ্ছা ছিল, বলছেন পর্যবেক্ষকরা। উল্লিখিত ১৬ মাসে উপদেষ্টা পরিষদের ৫১টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময়ে আইন ও বিধিবিধান সংশোধন করে জারি করা হয়েছে ৮১টি অধ্যাদেশ। এর মধ্যে ২০২৪ সালে ১৭টি এবং ২০২৫ সালে ৬৪টি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শতাধিক বিধি সংশোধন করা হয়েছে। আওয়ামী আমলে বিধ্বস্ত দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারে সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছে। ভয়াবহ লুটপাটে ফোকলা হয়ে যাওয়া ব্যাংক, বিমা খাতসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করতে নেওয়া হয়েছে নানা সংস্কার কর্মসূচি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট ও এনআইডি এবং তাদের ভোটাধিকার প্রদানের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দেশ থেকে প্রবাসে ছড়িয়ে পড়ে সরকারের সংস্কার কার্যক্রম।

এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের বার্ষিক সম্পদবিবরণী দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া বিভিন্ন ক্যাডারের ৮৪২ জন কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৬৪ জন ও অন্য ক্যাডারের (আদার্স ক্যাডার) ৭৮ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে পৃথক সচিবালয় গঠন করা হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের প্রধান কাজ তিনটি-সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন।

বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদের ৫১টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় এই সরকারের যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সময়ে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাব ছিল না।

১৬ মাসে সরকারের সাফল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্য ও ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি খাদ্য ও ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে বলতে পারব। এখানে বেশ কিছু ভালো কাজ হয়েছে। ওভারঅল সরকারের বিষয়ে আমি বলতে চাই না। এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।’

বিগত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসন, সীমাহীন লুটপাট, গুম, খুন, গায়েবি মামলা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জুলুম, মামলা-হামলায় জনগণের নাভিশ্বাস পরিস্থিতি বিরাজ করে। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন, আত্মদান ও প্রতিরোধের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। এরপর গত বছরের ৮ আগস্ট গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ। প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের উপদেষ্টা আছেন ২৩ জন। মন্ত্রী পদমর্যাদাসম্পন্ন উপদেষ্টা রয়েছেন আরও ৫ জন।

দায়িত্বভার গ্রহণের পর পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রমিক অধিকার, নারী অধিকার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। স্বাধীন কমিশনের আওতায় ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত তদন্ত করা হয়। গুম কমিশন গঠন করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে সরকার। এছাড়া জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে অধিকাংশ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে নানা ধরনের সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে নানা মতানৈক্য রয়েছে। আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এছাড়া ইতঃপূর্বেও বিভিন্ন সরকারের সময় ২৩টি কমিশন গঠিত হয়েছিল। অধিকাংশ কমিশনের সুপারিশ ডিপফ্রিজে রয়েছে। গত ১৬ মাসে দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ প্রশাসন যখন একেবারেই নাজেহাল, তখন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জন-আকাক্সক্ষার মাত্রায় পৌঁছতে পারেনি বলে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সরকার ৮১টি আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করেছে। বহুল আলোচিত সরকারি কর্মচারীদের সম্পদবিবরণী ১৬ বছর পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছিল না। বিগত সরকার বারবার উদ্যোগ নিয়েও আমলাদের সম্পদবিবরণী নিতে পারেনি। আমলাদের বাধা এবং সরকারের দুর্বলতার কারণে তাদের সম্পদবিবরণী নেওয়া হয়নি। গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর সরকারি কর্মচারীদের বার্ষিক সম্পদবিবরণী দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে সম্পদবিবরণী নেওয়া হলেও তা যাচাই-বাছাই করা হয়নি। এ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।

এ সময়ের মধ্যে সরকার আর্থিক খাতে প্রভূত উন্নতিসাধন করেছে। সরকারের ওপর আস্থা রেখে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে এনেছেন। সরকারের সদিচ্ছায় দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়েছে। নির্ঘাত ধ্বংসের হাত থেকে সরকার অর্থনীতিকে স্বাভাবিক করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে। এছাড়া প্রবাসীদের পাসপোর্ট সেবা, এনআইডি প্রদান, ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভোটাধিকার প্রদানের অধিকার দেওয়া হয়েছে।

গত ১৬ মাসে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন বিষয়ে জনপ্রশাসন বিষেশজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, সরকারের সদিচ্ছা ছিল, আন্তরিকতা ছিল; তবে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচনে ভুল করেছে। অনেক আইন সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, এটা ভালো দিক। তবে আইনগুলো করার আগে ভারত ও পাকিস্তানের আইনগুলো দেখে নিলে আরও ভালো হতো। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ। ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, আইনকানুন সংশোধনে মুনশিয়ানা থাকতে হয়। সেটা ছিল না। পে-কমিশন নিয়ে এত কম সময়ে প্রতিবেদন দেওয়া হলে অনেক ত্রুটি থাকার শঙ্কা থাকে বলে মনে করছেন তিনি। মোটের ওপর সরকারের সদিচ্ছা ছিল বলে মনে করেন ফিরোজ মিয়া।