Image description

এক সপ্তাহ আগে ৪৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। গত ২৬ নভেম্বর কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশ পাওয়া শীর্ষ তিনজনই মেডিকেলের শিক্ষার্থী। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এদের দু’জনই ছিলেন বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা।

৪৫তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ডা. সাদিয়া সুলতানা মিতু পড়াশোনা করেছেন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে। তিনি ওই মেডিকেলের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনা চলাকালে ছাত্রলীগে যোগ দেন মিতু। ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গঠিত সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল ছাত্রলীগের কমিটিতে সহ-সভাপতি হন তিনি।

২০২২ সালের ১৩ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের ছেলেদের হল থেকে ২০ জনকে পিটিয়ে বের করে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনা ছাড়াও আরও বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থী নিপীড়নে জড়িত ছিল সংগঠনটি। তবে ওই ঘটনার অল্প কিছুদিন পর সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখে শাখা কমিটি দেয় আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ওই কমিটিতে সহ-সভাপতি পদ পান ডা. মিতু।

পুলিশ ক্যাডারে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ডা. হাদীদ হাসান হিমেল রংপুর মেডিকেল কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। সহপাঠীদের অভিযোগ, মেডিকেলে ওই সময়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটিতে না থাকলেও সংগঠনটিতে সক্রিয় ছিলেন হিমেল।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সাদিয়া সুলতানা মিতু শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় নেত্রী ছিলেন। পাশাপাশি ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত ‘সাংস্কৃতিক সংগঠন’ স্ফূরণের কমিটিতেও ছিলেন তিনি। সে সময়ে শাখা ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে।

bsl police cadrre
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন ডা. সাদিয়া সুলতানা মিতু

মেডিকেলটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৩ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের ছেলেদের হল থেকে ২০ জনকে পিটিয়ে বের করে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনা ছাড়াও আরও বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থী নিপীড়নে জড়িত ছিল সংগঠনটি। তবে ওই ঘটনার অল্প কিছুদিন পর সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখে শাখা কমিটি দেয় আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ওই কমিটিতে সহ-সভাপতি পদ পান ডা. মিতু।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডা. সাদিয়া সুলতানা মিতুর একাধিক সহপাঠী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ক্যাম্পাসে মিতু ছিলেন তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৌরভ ঘোষের গ্রুপের নেত্রী। তিনি নেতৃত্ব দেওয়া স্ফূরণও নিয়ন্ত্রণ করত এই গ্রুপ। যে সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন করত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা, সে সময়েই সংগঠনটির মূল নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন মিতু।

তবে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাউকে নিপীড়নের বিষয়ে কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। যদিও সহপাঠীদের সঙ্গে মিতুর ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভাল ছিল না বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন। তারা বলছেন, ডা. মিতু কিছুটা ঝগড়াটে ছিলেন। ফলে সহপাঠীরা তার সঙ্গে ভালভাবে মিশতেন না।

আমি হোস্টেলে থেকে এমন কোন কাজ করিনি, যাতে কেউ নিপীড়িত হয়। কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে যে আমি ওই পদটা হোল্ড করতাম—ডা. সাদিয়া সুলতানা মিতু

ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ থাকার বিষয়টি স্বীকার করে ডা. সাদিয়া সুলতানা মিতু দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি হোস্টেলে ছিলাম। আর হোস্টেলে থাকতে হলে কম-বেশি সবারই ছাত্রলীগের সঙ্গে ওঠা-বসা করা লাগত। যেটা ছেলেদের হোস্টেলে হয়েছে, এটা পুরোটাই অনাকাঙ্ক্ষিত। আমি এটা কখনোই সাপোর্ট করি না, কিন্তু আসলে হোস্টেলে থাকা দরকার ছিল সেজন্য পোস্টটা হোল্ড করা।’

তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে আমাদের ইন্টার্নশিপ শুরু হয়ে ২০২২ সালে শেষ হয়। যখন কমিটিতে নাম আসে, তখন আমি চাকরি করতাম। একই সাথে হোস্টেল এবং বাসা মিলিয়ে থাকতাম। যারা হোস্টেলে থাকে, তাদের সবাইকেই নামটা লেখাতে হয়। আর আমি প্রধানত সাংস্কৃতিক সংগঠনটা করতাম। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে জড়িত থাকায় স্ফূরণের সঙ্গে ছিলাম।’

সহপাঠীদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সহপাঠী বা আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে, আমার ব্যাচের মধ্যে কেউ এরকম বলার কথা না। তারপরেও যদি বলে থাকে, আমি মনে করি এটা তার ব্যক্তিগত আক্রোশ। আমি পারসোনালি কারো সাথে মারামারি বা কারো সাথে এরকম অন্যায়, এমনকি আমার জুনিয়র লেভেলের কারো সাথেও কিছু নাই। ছোটখাটো দুই একটা অকারেন্স- কথা কাটাকাটি থাকতে পারে। এটার জন্য কেউ যদি আমার উপর আক্রোশ রাখে, সেক্ষেত্রে তো আসলে কিছু করার নাই। আমি হোস্টেলে থেকে এমন কোন কাজ করিনি, যাতে কেউ নিপীড়িত হয়। কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে যে আমি ওই পদটা হোল্ড করতাম।’

এ ছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও সরকারি বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন বলেও দাবি করেন তিনি।

heemel
রমেক ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানের ‘আয়োজক’ ছিলেন হাদীদ হাসান

আমার রুমমেট ছিল শিবিরের। আমার আরেকটা রুমমেট ছিল রাকিব, ছাত্রদলের সভাপতি। তার মানে আমি ওদের সাথে কানেক্টেড ছিলাম, বিষয়টা এরকম না— ডা. হাদীদ হাসান হিমেল

এদিকে রংপুর মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. হাদীদ হাসান হিমেল পরবর্তীতে ইন্টার্নশিপ শেষ করেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে। বর্তমানে একটি বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন তিনি। রংপুর মেডিকেল কলেজে তার সঙ্গে পড়াশোনা করা একাধিক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, কমিটিতে পদ না থাকলেও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলেন হিমেল। ক্যাম্পাসটিতে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের মধ্যে একটির নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গেও তাকে দেখা যেত।

278
শাখা ছাত্রলীগের পদধারী নেতাদের সঙ্গে হাদীদ হাসান হিমে
IMG_20251204_224546_457
ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানের মঞ্চে হিমেল

ব্যক্তিগতভাবে হাদীদ হাসানের বিরুদ্ধে কাউকে নিপীড়নের অভিযোগ শোনা না গেলেও তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে থাকা অবস্থায় শিক্ষার্থীদের উপর বেশ নিপীড়ন চালায় সংগঠনটি। বিশেষ করে ছাত্রলীগে সক্রিয় ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীরা বেশ উচ্ছৃঙ্খল ও আক্রমণাত্মক ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার সহপাঠী ও রংপুর মেডিকেল কলেজের অন্তত ৭ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে  দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিবেদকের। তাদের প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, হিমেল আওয়ামীপন্থী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রংপুরের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ডা. এ কে এম নুরুন্নবী লাইজুর অনুসারী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রিয়াদ সানাউলের গ্রুপে ছিলেন। কোনো কমিটিতে তার পদ-পদবী না থাকলেও বিভিন্ন কর্মসূচিতিও অংশ নিতেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছাত্রলীগের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন তিনি। তবে তারা এ-ও জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের থাকলেও হাদীদ হাসান ব্যক্তিগতভাবে কাউকে নিপীড়ন করেছেন বলে তারা শোনেননি বা দেখেননি। যদিও ওই সময় সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের উপর বেশ দমন-নিপীড়ন চালায়। বিশেষ করে ছাত্রলীগে সক্রিয় ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীরা বেশ উচ্ছৃঙ্খল ও আক্রমণাত্মক ছিলেন।

IMG_20251204_211122_889
ফটোশেসনে রমেকের ২০১৫-১৬ সেশন থেকে ছাত্রলীগে সক্রিয়রা, ডান থেকে তৃতীয় হাদীদ হাসান হিমেল

 

হিমেল আওয়ামীপন্থী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রংপুরের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ডা. এ কে এম নুরুন্নবী লাইজুর অনুসারী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রিয়াদ সানাউলের গ্রুপে ছিলেন। কোনো কমিটিতে তার পদ-পদবী না থাকলেও বিভিন্ন কর্মসূচিতিও অংশ নিতেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছাত্রলীগের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন তিনি।

তবে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন ডা. হাদীদ হাসান হিমেল। তিনি বলেন, ‘আমার রুমমেট ছিল শিবিরের। আমার আরেকটা রুমমেট ছিল রাকিব, ছাত্রদলের সভাপতি। তার মানে আমি ওদের সাথে কানেক্টেড ছিলাম, বিষয়টা এরকম না। আমাদের কোন কালচারাল ক্লাব, কোন ডিবেটিং ক্লাব, কোন স্পোর্টস ক্লাব, শিবির, লীগ বা ছাত্রদল দূরের কথা, সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাব, ফ্রেন্ডস ক্লাব— এরকম কোন ক্লাব বা  কোন জায়গায় আমার এফিলিয়েশন ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘ফার্স্ট ইয়ার থেকে মোট তিনটা কমিটি হয়েছিল ছাত্রলীগের। আমি কোনো কমিটিতেই ছিলাম না। এ ছাড়া সবসময় নন-পলিটিক্যাল ব্লকে আমার সিট ছিল।’