Image description
সংসদ নির্বাচন ও গণভোট

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ১১ ডিসেম্বর ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটগ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ ৮, ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারির যে কোনো একদিন। তফসিল ঘোষণার আগে রেওয়াজ অনুযায়ী ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা। পরদিন ১১ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তফসিল ঘোষণা করবেন সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন।

ইতোমধ্যে সিইসির ভাষণের খসড়া তৈরি হয়েছে। ভাষণে মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হবে। ভোটার, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য থাকবে বেশ কিছু সতর্কবার্তা। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ কার্যক্রম শুরু করবে ইসি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এর আগে জানানো হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। দুই নির্বাচনের জন্য পৃথক রঙের দুটি ব্যালট দেওয়া হবে ভোটারদের। একই দিনে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় এবার ইসিকে বাড়তি অনেক ধরনের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার আগে ওই সব প্রস্তুতির অগ্রগতি পর্যালোচনায় রোববার নির্বাচন কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ওই সভায় গণভোট আয়োজনসহ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা, আইন ও রীতির আলোকে তফসিলের আগে ও পরের কার্যক্রমসহ ৯টি আলোচ্যসূচি রয়েছে। ওই বৈঠকে তফসিল চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত রয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে দেশের সবাই বিস্তারিত জানতে পারবেন। তিনি বলেন, আমরা শিগগিরই কমিশন সভায় বসব। ওই সভায় নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমগুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার, তার সবই করা হবে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটাই প্রথম নির্বাচন। এ নির্বাচন ঘিরে ইসির যেমন কর্মতৎপরতা রয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয়। বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ অনেক দল তফসিল ঘোষণার আগেই তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দিয়েছে। ওইসব প্রার্থীরা নিজ এলাকায় চষে বেড়াচ্ছেন। তাদের ঘিরে তৈরি হয়েছে ভোটের আমেজ। এছাড়াও নতুন নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন হচ্ছে। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা জাতীয় পার্টির (জাপা) একাংশের চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক জোট’ নামেও নতুন রাজনৈতিক জোট গঠিত হচ্ছে। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশ নিতে আইনগত বাধা দেখছে না ইসি। তবে কার্যক্রম স্থগিত থাকায় আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত বলা যায়। পোস্টাল ব্যালটেও দলটির প্রতীক থাকছে না বলে জানা গেছে।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, এবারের নির্বাচনি তফসিলে বেশকিছু নতুনত্ব থাকছে। দেশে এবারই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পৃথক দুটি ব্যালট দেওয়া হবে ভোটারদের। একটিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক থাকবে। আরেকটি ব্যালটে উল্লেখ থাকবে জুলাই জাতীয় সনদের ওপর চারটি প্রশ্ন। যারা এসব প্রশ্নের পক্ষে থাকবেন তারা হ্যাঁ এবং যারা বিপক্ষে তারা না প্রতীকে ভোট দেবেন। ভোটাররা দুটি ব্যালটেই তাদের পছন্দের প্রতীকে ভোট দেবেন। দুটি ব্যালটে ভোট দিতে ভোটারদের বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে। এ কারণে এবার ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ছে। বাড়বে ভোটকক্ষ এবং ভোটকক্ষে সিল মারার গোপন কক্ষের সংখ্যাও। তবে ভোটকেন্দ্র বাড়াতে রাজি নয় ইসি। এছাড়া প্রথমবারের মতো বিদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি এবার ভোট দিতে অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন।

ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, এবার মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমা বেশি দেওয়া হবে। মনোনয়নপত্র বাছাই, বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিলের সময়ও বেশি থাকছে। নির্বাচনি প্রচার চালাতে বেশি সময় পাবেন প্রার্থীরা। এই নির্বাচনে পোস্টার ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকছে। এর পরিবর্তে বিলবোর্ড, ডিজিটাল ডিসপ্লে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানোর সুযোগ রয়েছে।

কর্মকর্তারা বলেন, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারলে ভোট বানচালে দলটি অপচেষ্টা চালাতে পারে বলে ইসির কাছে তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি ভোটে অংশ নেওয়া দলগুলোর প্রার্থী ও সমর্থকরা নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় জড়াতে পারে। নির্বাচন সামনে রেখে ‘মব’ ও ‘নাশকতা’ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব কারণে সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করে নির্বাচনে আইন ও বিধি মানার অঙ্গীকার নেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছিল কমিশন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। এই অবস্থায় সরকারের হাতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ভার ছেড়ে দিয়েছে ইসি।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তফসিল ঘোষণা : জানা গেছে, প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সাক্ষাতের রেওয়াজ রয়েছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার আগে ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতে যাচ্ছে এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এরপর বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এদিন তফসিল ঘোষণা করবে ইসি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, কমিশন সভায় তফসিলের সময়সূচি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তফসিল চূড়ান্ত করা হবে। এ কমিশনার আরও বলেন, তফসিল ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের কথা তো আমরা বলে আসছি। সেক্ষেত্রে ৮ ডিসেম্বর থেকে যে কোনো দিন হবে। আর ভোটের তারিখও হবে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনো একদিন। তফসিল ঘোষণা থেকে ২ মাস পর ভোট হবে।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির কথা বিবেচনায় রেখে ভোটের দিন ঠিক করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার বা শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারকে বেছে নেওয়া হয়। আগের অভিজ্ঞতার আলোকে এবারও তারিখ চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। তারা আরও জানান, ভোটগ্রহণের দিন হিসাবে ৮, ১১ অথবা ১২ ফেব্রুয়ারি আলোচনায় রয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি রোববার, ১১ ফেব্রুয়ারি বুধবার ও ১২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার হয়। গত ১২টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দ্বিতীয়, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ ভোট হয়েছে রোববার। অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচন হয়েছে সোমবার। প্রথম, তৃতীয়, পঞ্চম ও সপ্তম সংসদ নির্বাচন হয়েছে বুধবার। আর চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন বৃহস্পতিবারে হয়েছে। সার্বিক হিসাবে ৮ বা ১২ ফেব্রুয়ারি বেশি আলোচনায় রয়েছে।

শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি : তফসিল ঘোষণার আগে সরকার ও ইসি শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি শেষ করে আনছে। এরই অংশ হিসাবে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বৃহস্পতিবার ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ (আরপিও) সংশোধনী অনুমোদন হয়েছে। ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা’র সংশোধনী এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার সংশোধনী সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ইসি। দু-এক দিনের মধ্যে এসব বিধিমালার সংশোধনী গেজেট আকারে প্রকাশের কথা রয়েছে। গতকাল ‘জনতার দল’ এবং ‘আমজনতার দল’ নামক দুটি রাজনৈতিক দলকে নতুন করে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। আমজনতার দলের প্রতীক প্রজাপতি এবং জনতার দলের প্রতীক ‘কলম’।

এছাড়া প্রবাসীদের জন্য পাঁচ লাখ পোস্টাল ব্যালট ছাপতে যাচ্ছে কমিশন। আর্মি প্রিন্টিং প্রেসে এসব ব্যালট ছাপা হবে। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই এসব ব্যালট নিবন্ধন করা প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের কাছে পাঠাতে শুরু করবে ইসি। এ কাজটি সম্পন্ন করবে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। পাশাপাশি সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম স্থগিত করতে উচ্চ আদালতে দায়ের হওয়া রিটের আইনি লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছে কমিশন। এছাড়া নির্বাচনি মালামাল আগেই সংগ্রহ করেছে কমিশন। ভোটকেন্দ্র ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে আইনগত কোনো ধরনের জটিলতা নেই। প্রস্তুতিও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন বাকি তফসিল ঘোষণা।