Image description

প্রভাবশালীদের ইন্ধনেই টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর একরামুল হককে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। তার কোনো অপরাধ ছিল না। ইয়াবা কারবারেও জড়িত ছিলেন না তিনি। থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) ছিল না তার নামে। তবু তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। কারণ একটাই, এলাকায় তার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছিল।

আটক হওয়া থেকে শুরু করে ক্রসফায়ারের আগপর্যন্ত একরাম ও তার স্ত্রী এবং সন্তানদের কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে। ওই রেকর্ড ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল কতিপয় কর্মকর্তা। সেটা করতে না পেরে কোটি টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল একরামের স্ত্রীকে। তাতে সাড়া দেননি তিনি। সম্প্রতি নিজ বাসায় দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম।

আয়েশা বেগম বলেন, ‘একরামের জনপ্রিয়তাই শঙ্কিত করেছে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রকে। তারা র‌্যাব ও ডিজিএফআইকে দিয়ে একরামকে শায়েস্তা করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা। একরামকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার পেছনে রয়েছেন কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি এবং তার স্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহিন আক্তার এবং টেকনাফ উপজেলার চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ।’

তিনি বলেছেন, ক্রসফায়ারের আগে তার সঙ্গে একরামের কথা হয়। গুলি করার পরও একরাম কথা বলছিলেন। পুরো কথোপকথন তার মোবাইলে রেকর্ড করা হয়েছে। রেকর্ডটি পেতে তাকে এক কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুটি সংস্থার দুই কর্মকর্তা। কিন্তু তিনি টাকার কাছে বিক্রি হননি। যারা তাকে হত্যা করেছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। 

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন পর্যন্ত সারাক্ষণ তার বাসার আশপাশে সিভিল টিমের সদস্যরা ঘোরাফেরা করেছেন। সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি, তার স্ত্রী সাংসদ শাহিন আক্তার ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদের কাছে সহায়তা চেয়েও পাননি তিনি। ক্রসফায়ারের বিষয়টি তাদের বেশ কয়েকজন স্বজন আগে থেকেই জানতেন। তিনি বলেন, ‘সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’ সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তার মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছিল। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি।’

আবেগাপ্লুত আয়েশা বেগম বলেন, ‘একরামুল হক টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন। তিনি টেকনাফ থানা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। তাহিয়াত হক ও নাহিয়ান হক নামে দুই সন্তান আছে তার। তারা টেকনাফ কলেজে পড়ে। একজন বিএ ও আরেকজন পড়ে এইচএসসিতে।’ 

তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের ২৬ মে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা সকাল থেকেই ফোন দিতে থাকে একরামের মোবাইলে। ওই সময় তিনি বাসায় ছিলেন। দিনটি ছিল রমজান মাসে। তখন একরামকে খুবই অস্থির দেখাচ্ছিল। তার অবস্থা দেখে আমারও মনটা ভালো ছিল না। বারবার ওরা ফোন দিয়ে বলছিল, কক্সবাজার থেকে র‌্যাবের একজন মেজর আসছেন। আপনার সঙ্গে উনি কথা বলতে চাচ্ছেন। আপনাকে নিয়ে একটা মিটিং হবে। তখন একরাম বলছিলেন, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি পরে আসব। যে ফোন দিচ্ছিল তার সঙ্গে আগ থেকেই একরামের পরিচয় ছিল। সে কথোপকথন রেকর্ড করা আছে। আমার সামনেই কথাগুলো হচ্ছিল। ফোনের ওই প্রান্ত থেকে বলা হচ্ছিল, এতদূর থেকে র‌্যাবের মেজর আসতে পারবে আর আপনি কাছ থেকে আসতে পারছেন না। একরাম তাকে বলেন, আগামীকাল মেয়েকে স্কুলে দিয়েই আপনাদের সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু তাতেও রাজি হচ্ছিলেন না ওই কর্মকর্তা। উনার চাপাচাপিতে একপর্যায়ে যেতে রাজি হন একরাম। আমিও চাচ্ছিলাম তিনি যাতে না যান। ইফতারের পরই আবারও ফোন। পরে একরাম নেটেং যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। এ যাওয়াই ছিল তার শেষ যাওয়া।’

আয়েশা বেগম বলেন, ‘বাড়ির মানুষ নাকি আগ থেকে জানত, একরামকে ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। কিন্তু এ কথা আমাকে বলেনি। কেন গোপন রেখেছে তারা বলতে পারব না। বাড়ির সবার সঙ্গেই একরামের সুসম্পর্ক ছিল। কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ ছিল না। যাওয়ার পর মেয়ে বাবার মোবাইলে ফোন দিয়ে বলে, আব্বু বাসায় তো বিদ্যুৎ নেই। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। তখন একরাম র‌্যাব অফিসে ছিলেন। ২৫ মে আমার বড় ভাশুর ও উনার ছেলে নাকি জানতে পারেন, একরামকে ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। কিন্তু তারা জানাননি। অনেক দিন পর এ কথা জেনেছি। এ কারণে মনে কষ্ট লাগছে বেশি। ঘরের মানুষ জানল অথচ আমি জানলাম না। এটা আমাকে এখনো পীড়া দিচ্ছে। আগে জানলে তাকে বাসা থেকে বের হতে দিতাম না।’

তিনি বলেন, ‘একরাম তো কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এলাকায় তার সুনাম ছিল। তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা ছিল না। একবার দুদক তাকে আগ্রাবাদে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। উনারা আমাদের সম্পদের তথ্য যাচাই করেছেন। কই, কিছু তো পায়নি তারা! সম্পত্তি বলতে শুধু আছে তার বাবার বাড়িটি। বাড়িটি তিন ভাইয়ের। দোতলার এক পাশে আমরা থাকি। ব্যাংক ব্যালান্স নেই। ক্রসফায়ারের সময় একরামের কাছে তিনটি মোবাইল, একটি ঘড়ি ও একটি চশমা ছিল। সারা পৃথিবী জানে, আমার স্বামী নির্দোষ। কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা উদঘাটন করতে হবে। আমি বাংলাদেশের নাগরিক। পুলিশ বার্মার লোকদের হেফাজতে রেখে আদর-যত্ন করেছে, অথচ আমাদের কোনো সাহায্যই করেনি। আমার স্বামী আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। উনি কেন বিচার পাবেন না? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রধানমন্ত্রী নাকি কোনো অর্ডার দেয়নি। তাহলে কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে? র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে কারা জড়িত আমি জানতে চাই। কে খুনি তা জানতে চাই। আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।’

আয়েশা বলেন, ‘ক্রসফায়ারের পর ২০১৯ সালের ৮ জুলাই র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বাসায় এসে মোবাইলের অডিও রেকর্ডটি ফেরত দিতে কোটি টাকার অফার করেছিলেন। আমি রাজি হইনি। র‌্যাবের ওই কর্মকর্তার নাম সৈয়দ আলম। উনি উখিয়ায় ছিলেন। উনাকে মোবাইল দিইনি। অডিও রেকর্ড না পেয়ে তারা আত্মীয়স্বজনদের নানাভাবে ডিস্টার্ব করছিলেন। আমার শ^শুরবাড়ির লোকজন আতঙ্কে ছিল। আমরা কারোর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। সাদা পোশাকধারী লোকজন বাসার আশপাশে ঘোরাফেরা করত সারাক্ষণ। আমার স্বামী ইয়াবা কারবারে সঙ্গে জড়িত কি না, তা কেন যাচাই করা হলো না। আমার বাচ্চারা এখনো কান্নাকাটি করছে। তারা এখনো জানে, বাবা এসে ভাত খাওয়াবে। আমরা এখন ঘুমাতে পারি না। আমাদের অনেক কষ্ট। সারাটি জীবন একরাম পরিবারের জন্য কষ্ট করে গেলেন। কষ্ট করে একটি রুমে থাকতেন। দুটি মেয়ে বাবাকে খুব মিস করছে। প্রতিদিন মোটরসাইকেলে করে একরাম তাদের স্কুলে দিয়ে আসত। তারা এখন বাবার কাপড়চোপড় পরে। তারা বাবার গন্ধ পেতে চায়। ক্রসফায়ারের দিন যে পোশাক পরিধানে ছিল সেগুলো মাটিতে পুঁতে রেখেছে তার চাচ্চুরা। এগুলো পেতে চায় তারা। তারা বলে, ইয়াবা কারবারিদের ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। আর আমার আব্বুকে ওরা মেরে ফেলেছে। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারি না।’ 

আয়েশা বলেন, ‘একরাম মারা যাওয়ার পর অভাব-অনটনের মধ্যে চলছে সংসার। আমার দেবর কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাউন্সিলর থাকার সুবাদে একরাম যে ১০ হাজার টাকা পেতেন তা এখন পাচ্ছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে। টাকার অভাবে ঠিকমতো খেতেও পারছি না। সন্তানরা প্রায়ই না খেয়ে থাকছে। এভাবে আর কতদিন চলবে? আমার আতঙ্ক রেকর্ডটা নিয়ে। একজন সরকারি কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএর কাছে ফোন করেছিলাম। উনারা বলেছেন র‌্যাব আর ডিস্টার্ব করবে না। তারপর তারা ডিস্টার্ব করছে না। একরামের মারা যাওয়ার ব্যাপারে কোনো মামলা করতে পারছিলাম না। আমরা চেয়েছিলাম, স্বামীকে হত্যা করায় আদালতে মামলা করব। কিন্তু ভয়ে পারিনি। ক্রসফায়ার নিয়ে যাতে কোনো কিছু করা না হয় সেজন্য মানসিকভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আমরা কথাই বলতে পারছিলাম না। ক্রসফায়ারের পরদিন কক্সবাজারের এক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। কিন্তু উনারা মামলা করতে রাজি হননি। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও চাচ্ছিল না মামলা করতে। মামলা করলে দেবর বা ভাশুররা সমস্যায় পড়বেন এ আশঙ্কা ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ায় এখন সাহস পাচ্ছি। দেখি কী করা যায়!’

তিনি বলেন, ‘স্বামী হিসেবে তিনি মাটির মানুষ ছিলেন। এলাকার লোকজনকে সেবা দিতেন। সময় পেলেই সন্তানদের কাছে চলে আসতেন। তাদের ফোন পেলেই তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। যত কাজই থাকুক তিনি সন্তানদের কাছে চলে আসতেন। এখন কলেজে গিয়ে সন্তানরা বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। শিক্ষকরা তাদের খুব আদর করেন। তাদের সান্ত্বনা দেন।’

ক্রসফায়ারের বিষয়ে আয়েশা বেগম বলেন, ‘এ ঘটনার পেছনে স্থানীয় মহলের ইন্ধন ছিল। ঘটনার পরদিন সাবেক সাংসদ বদির সঙ্গে যোগাযোগ করেও লাভ হয়নি। জাফর চেয়ারম্যানকেও বিষয়টি জানানো হয়। তাদের বলা হয়েছিল, র‌্যাব ও ডিজিএফআইকে ডাকেন। কিন্তু তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান। ঘটনার দিন আমার দেবর এমপি সাহেবকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু উল্টো বদি সাহেব তাকে বলেছিলেন, ওখানে কেন গিয়েছে একরাম? এমপি হিসেবে এটা কি উনি বলতে পারেন? অথচ বদি সাহেবের মুক্তির জন্য একরাম প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং করেছিলেন। ক্রসফায়ারের পেছনে এলাকার প্রভাবশালী লোকজনের ইন্ধন ছিল। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। আমি জানতে চাই ওই প্রভাবশালীদের নাম।’