‘আমার বাবাকে আমি দিখিনি। তাকে চিনিও না। বড় হয়ে শুনেছি, আমার বয়স যখন এক, তখন বাবাকে বিডিআর হত্যা মামালায় আসামি করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর বাবার মুখ দেখতে পাব।
জুয়েনা জামাল ঐশী যখন কথা বলছিলেন তখন তার গাল বেয়ে পড়ছিল চোখের পানি।
বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টার কিছু সময় পর কারাফটক দিয়ে বের হয়ে হাসেন ঢাকা সদর ব্যাটিলয়নের সিপাহী আবু হাসান (৩৬)। গলায় ফুলের মালা দিয়ে স্বজনারা তাকে ঘিরে আনন্দে মেতে উঠেন।
আবু হাসান জানান, ‘যখন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে তখন আমার চাকরির বয়স মাত্র ছয় মাস। পিলখানাতে পাঁচটি গেট আছে। সেই পাঁচটি গেটের একটাও আমি চিনতাম না। অথচ আমাকে করা হয়েছে মামলার আসামি। যেসব স্যারদের পিতা সমতুল্য সম্মান করতাম তাদের হত্যার দায়ে মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করতে হয়েছে ১৬টি বছর’।
তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া মুক্ত হতে পেরেছি। সরকারের কাছে একটাই দাবি, বিনা অপরাধে জেলা খেটেছি। এখন যেন হারানো সম্মান ফিরে পাই। চাকরি ফেরত পাই।’
কারো হাতে ফুল, কারো হাতে ফুলের মালা। চোখেমুখে আন্দের ঝিলিক। কারা ফটক দিয়ে একে একে বের হতেই কেউ স্বজনদের বুকে জড়িয়ে ধরছেন। সান্নিধ্যের উষ্ণ পরশ পেয়ে খুশিতে কেউ বুক ভাসাচ্ছেন চোখের পানিতে।
বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় সৈনিকদের জামিনে মুক্তি পাওয়া উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারা কমপ্লেক্সের সামনে ছিল এমন ব্যতিক্রমী পরিবেশ।
১২৬ বিডিআর সদস্যের মুক্তির খবরে সকাল থেকে আজ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। প্রথমে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৩ জন বিডিআর সদস্য মুক্তি পেয়ে বের হন। এরপর বেলা সাড়ে ১২টার মধ্যে পর্যায়ক্রমে মুক্তি পান কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ থেকে ২৪ জন এবং কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে ৮৯ জন মিলিয়ে মোট ১২৬ জন।
এ সময় জামিনে মুক্তি পাওয়া বিডিআর সদস্যরা পরিবারের সদস্যদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েনন। অনেকে খুশিতে স্ত্রী-সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। পরিবার ও বিডিআর সদস্যদের আহাজারিতে কারাগারের প্রধান ফটকে হৃদয় বিদারক আবহের সৃষ্টি হয়।
জামিনে মুক্তি পাওয়া ময়মনসিংহ ৪৫ ব্যাটেলিয়ানের সিপাহী মো. এনামুল বলেন, ‘আমরা নিরপরাধ ছিলাম। মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। আমাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। সব প্রকার সুযোগ-সবিধা দিতে হবে। এ ঘটনায় যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ওই সময় আমাদেরকে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বলা হয়েছিল। কার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হবে আমরা কিছুই জানি না। সাক্ষী দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাদের মামলার আসামি করে কারাগারে পাঠায় খুনি হাসিনা সরকার।’
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্তি পাওয়া হাবিলদার সোলায়মান ও শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া, আজ আমরা জামিনে মুক্তি পেয়েছি। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী ছিল না। তাও ১৬টি বছর মিথ্যা মামলায় জেল খাটতে হয়েছে।’
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ এর সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহী হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া বিস্ফোরক আইনের মামলায় বৃহস্পতিবার ভোরে ১২৬ জন জওয়ানের জামিনের আদেশ কারাগারে এসে পৌঁছে। পরে যাচাই-বাছাই শেষে ১২৬ জন বিডিআর জওয়ানকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহী জওয়ানরা সংস্থাটির সদর দপ্তর রাজধানীর পিলখানায় নারকীয় তাণ্ডব চালায়। তখন তাদের হাতে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ ব্যক্তি। এই বিদ্রোহের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যা ও বিষ্ফোরক আইনে পৃথক দুটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। এতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২৭৮ জন খালাস পান। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর এই মামলায় হাইকোর্টে আপিলের রায় হয়।
অপরদিকে বিস্ফোরক মামলায় আসামি ৮৩৪ জন। মামলাটি হত্যা মামলার সঙ্গে বিচার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়নি। এক পর্যায়ে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত করে দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে মামলাটির বিচারকাজ শেষ হতে বিলম্ব হয়।
সর্বশেষ গত ২০ জানুয়ারি রবিবার পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা বিস্ফোরক মামলায় জামিন পেয়েছেন হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত ও যাদের বিরুদ্ধে কোনো আপিল হয়নি এমন দুই শতাধিক আসামি। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক ইব্রাহিম মিয়ার অস্থায়ী আদালত তাদের এই জামিন দেন।