Image description
রাজা যায় রাজা আসে দুর্নীতি টিকে থাকে

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনকালে আমলাতন্ত্রে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতির উৎসবে মেতে উঠেছিল কতিপয় আমলা। উচ্চপদস্থ আমলাদের হাতে রাখার কৌশল হিসেবে তাদের বেশুমার লুটপাট করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর দুর্নীতির দায়ে ১৮ জন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে শতাধিক আমলার বিরুদ্ধে। তার পরও বন্ধ হয়নি আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি।

গত দেড় বছরে আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে আলোচিত দুর্নীতির ঘটনা হলো জেলা প্রশাসক পদায়নে কোটি টাকার লেনদেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা সাবেক জনপ্রশাসন সচিবের টাকার বিনিময়ে জেলা প্রশাসকের পদায়ন সংক্রান্ত অডিও ফাঁস হয়। গণমাধ্যমে চেকের কপি প্রকাশিত হয়। প্রথমে এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেই তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। পরে চট্টগ্রামের ডিসি পদায়ন নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। প্রধান উপদেষ্টা নিজে বিষয়টি তদন্ত করেন। তদন্তের প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসন সচিবকে বদলি করা হয়। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থা বলছে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা কেবল বদলি হতে পারে না। অতিরিক্ত সচিব জিয়া উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে অনৈতিক অর্থ দাবি ও হয়রানির অভিযোগের বিষয়টি তদন্তে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

চলতি বছরের শুরুতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালীন জিয়া উদ্দীনের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেন একজন ভুক্তভোগী। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবু ইউছুফকে সভাপতি করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রোকেয়া বেগম। কমিটির সদস্য সচিব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এস এম নোমান হাসান খান। জিয়া উদ্দীন বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তদন্ত কমিটিকে সব প্রাসঙ্গিক বিধিবিধান অনুসরণ করে তদন্ত কাজ পরিচালনা করে সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। জিয়া উদ্দীন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে থাকার সময় বগুড়ার শিবগঞ্জের রূপসী ফ্লাওয়ার রাইস অ্যান্ড পুষ্টি মিলের মালিক মো. মহিদুল হক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অভিযোগ দেন।

অভিযোগে তিনি লেখেন, আমার রূপসী ফ্লাওয়ার, রাইস অ্যান্ড পুষ্টি মিলটি খাদ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত পেষণ ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্লাওয়ার মিল। জেলা প্রশাসক, বগুড়া গত ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের স্বার্থে আমার ফ্লাওয়ার মিলটি বগুড়ার শিবগঞ্জ পৌরসভার ও কাহালু পৌরসভার ওএমএসের একক পেষণ ক্ষমতা প্রদানের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবর পত্র প্রেরণ করি।

তিনি আরও লিখেছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় জেলা প্রশাসক, বগুড়া গত ৯ জানুয়ারি শিবগঞ্জ ও কাহালু পৌরসভার পেষণ ক্ষমতা প্রদানের সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। উল্লিখিত বিষয়াদিসহ অনুমোদনের জন্য নথিটি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপিত হলে নথিটি স্বাক্ষর না করে আমার নিকটাত্মীয় বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মীর শাহে আলমকে সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে অনুমোদনের শর্তে ২০ লাখ টাকা অনৈতিক দাবি করেন।

তিনি টাকা না দেওয়ায় জিয়া উদ্দীন এ-সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদন দেননি, উল্টো আবারও তদন্তের জন্য পাঠান। তদন্তে তার পক্ষে সুপারিশ দেওয়া হলেও সেটা অতিরিক্ত সচিব না মেনে তাকে পরে আরও হয়রানি করেন বলে চিঠিতে অভিযোগ করা হয়।

এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু অভিযুক্ত কর্মকর্তা এখনো পদে বহাল আছেন।

ময়মনসিংহের ফুলপুরে স্থানীয় সরকার সচিবের পারিবারিক কবরস্থানের উন্নয়নে জেলা পরিষদ আটটি প্রকল্পে ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেনের বিরুদ্ধে সচিবকে খুশি করতে এমন কাজের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি, কম্বল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের পর তাকে বদলি করা হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি তদন্ত করছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। দুদকের পরিচালক ঈশিতা রনি স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অনুসন্ধান শুরুর বিষয়ে জানানো হয়েছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে মোহাম্মদ এজাজকে এক বছরের জন্য নিয়োগ দেয় অন্তর্র্বর্তী সরকার। দুদকের চিঠির সংক্ষিপ্ত শিরোনামে বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক নানাবিধ অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ। আমলাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্র্বর্তী সরকার আগের পথেই হাঁটছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বটে কিন্তু সেই তদন্তের অগ্রগতি হয় না। নতুন বাংলাদেশেও দুর্নীতিবাজ আমলারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।