ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে তার চাকরি জীবনের প্রায় ৫৪ শতাংশ সময় ছুটি কাটানোর অভিযোগ উঠেছে। ২২ বছরের চাকরি জীবনের প্রায় ১২ বছরই ছুটিতে কেটেছে তার। তিনি হলেন- লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. এস.এম. শফিকুল আলম। এই নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হলে দীর্ঘ ১০ মাস পেরোলেও প্রতিবেদন জমা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড. শফিক ২০১০ সালের ২৯ জুন হতে ১৫ ই জুলাই পর্যন্ত অর্জিত ছুটি নেন ১৭ দিন। এর মধ্য দিয়ে তার ছুটি ভোগ করার সুদীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়। পরে একই বছরের ২৩ আগস্ট হতে ২২ আগস্ট ২০১৫ সাল পর্যন্ত সবেতনে পাঁচ বছর শিক্ষা ছুটি নেন। সবেতনে ছুটি শেষ হওয়ার পরদিন থেকে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি বিনা বেতনে এক বছর দুই মাস তেইশ দিন অসাধারণ ছুটি নেন। এরপর কিছুদিন বিভাগে যোগদান করেন। পরের বছর ২০১৭ সালের ১৫ ই মার্চ হতে ১৮ ই মে পর্যন্ত চৌষট্টি দিন চিকিৎসার জন্য তিনি অর্জিত ছুটি নেন।
পরে আবার একই সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি পঁচাত্তর দিন অর্ধগড় বেতনে ছুটি নেন। একই বছরের ২৭ এপ্রিল থেকে ১৪ ই মে পর্যন্ত ১৮ দিন পুনরায় চিকিৎসা ছুটি নেন তিনি। এরপর ২০১৮ সালে ২৭ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত এক বছর স্যবটিক্যাল ছুটি নেন তিনি। পরে একসাথে পাঁচটি শ্রান্তিবিনোদনের পচাত্তর দিন ছুটি নেন এই অধ্যাপক। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ১৭ ই জুন পর্যন্ত দুইশত বাষট্টি দিন অর্জিত ছুটি নেন তিনি।
পরে ১৮ ডিসেম্বর ২০২২-এ তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় প্লানিং কমিটির সুপারিশের আলোকে পুনরায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ পর্যন্ত দুইশত আট দিন অর্জিত ছুটি মঞ্জুর করে চিকিৎসার জন্য তাঁকে ফিনল্যান্ড অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হয়৷ পরে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে ছুটি শেষে পহেলা মার্চ ২০২৩ সালে কর্মস্থলে যোগদান করার কথা থাকলেও তিনি আর যোগদান করেন নি। পরে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত প্রতিবেদন লেখার সময়কাল পর্যন্ত তিনি কর্মস্থলে যোগদান করেননি।
অর্থাৎ তিনি সর্বমোট ছুটি ভোগ করেছেন ৩ হাজার ৩০১ দিন যা প্রায় ৯ বছর সমতূল্য। এছাড়া অননুমোদিতভাবে অনুপস্থিত আছেন ৯৭৪ দিন (১ মার্চ ২০২৩ থেকে প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ৩০ নভেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত)। যা প্রায় আড়াই বছরেরও বেশি সময়।
অধ্যাপক ড. এস.এম. শফিকুল আলম চাকরিতে যোগদান করেন ২০০৩ সালের ১১ ডিসেম্বর। পরে ২০০৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর ২০১০ সালের ২৯ জুন হতে তার ছুটি ভোগের যাত্রা শুরু হয়। তিনি ফিনল্যান্ডে যান পিএইচডি ডিগ্রি করতে। এরপর থেকে সেখানেই অবস্থান করছেন বলে জানা যায়।
শিক্ষক সেলের উপ-রেজিস্ট্রার এনামুল ইসলাম বলেন, তিনি পহেলা মার্চ ২০২৩ সাল থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তার পূর্বের ছুটির পদ্ধতিগত বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, পূর্ববর্তী সকল প্রশাসন তার ছুটি মঞ্জুর করার করণেই এত দীর্ঘ সময় সে ছুটি ভোগ করেছেন। যতদূর জেনেছি এই ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে তিনি একটানা একাধিক ছুটি ভোগ করা এবং সর্বশেষ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি শৃঙ্খলা বিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইবির এক অধ্যাপক বলেন, ‘একজন শিক্ষকের এত দীর্ঘ সময় শ্রেণিকক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে থাকা স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ক্ষতিকর। তিনি নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিগত সময়ের এবং বর্তমান প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে এই ছুটির মহোৎসব ভোগ করে চলেছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তিনি জীবনযাপন করছেন। এছাড়া সবচেয়ে বড় ব্যাপার কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া তিনি দেশের বাহিরে অবস্থান করলেও বর্তমান প্রশাসন তার বিরুদ্ধে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। যা জাতির সাথে প্রহসন করার সমতূল্য।’
অর্থ ও হিসাব শাখায় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে তার বেতন স্থগিত করা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিবীধি লঙ্ঘন করে তিনি বিদেশে অবস্থান করলেও তার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি প্রশাসনকে।
এদিকে এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বর্তমান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলীকে আহ্বায়ক, আল ফিকহ এন্ড ল’ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আনোয়ারুল ওহাবকে সদস্য এবং উপ-রেজিস্ট্রার আলীবদ্দীন খানকে সদস্য সচিব করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশাসন। তবে দীর্ঘ ১০ মাস পেরোলেও প্রতিবেদন জমা দেয়নি ওই কমিটি।
বিষয়টি নিয়ে কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী বলেন, 'তিনি যে প্রক্রিয়ায় একাধিক বার ছুটি নিয়েছেন সেটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়৷ তার সাথে আমরাও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। সে আমাদের সাথেও যোগাযোগ করেনি। বর্তমানে সে কোথায় আছে, কোন দেশে অবস্থান করছে আমাদের জানা নেই। তবে আমরা খুব দ্রুতই একটি মিটিং করে উপাচার্য মহোদয়কে সিদ্ধান্ত জানাবো।'
লোক প্রশাসন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. ফকরুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিভাগে এমনিতেই শিক্ষক সংকট রয়েছে। তার মতো একজন একাডেমিশিয়ানের সহযোগিতা পেলে বিভাগটি আরও উন্নত হতো। আশা করি তিনি জয়েন করবেন।
অভিযুক্ত শিক্ষক ড. এস এম শফিকুল ইসলামের সাথে কথা বললে বর্তমানে তিনি ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়ে সেখানে স্ত্রী-বাচ্চাসহ অবস্থান করছেন বলে জানান। তিনি বলেন, গতবছর আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আমি দেশে ফিরতে পারি নাই। আগামী সপ্তাহে সর্বশেষ মেডিকেল চেকআপ আছে। সেটার পর ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আমি চাকরি থেকে রিজাইন দিতে চাই। আমার বর্তমান শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ। ছাত্রদের টিচিং করানোর মতো সামর্থ্য নেই আমার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, আমরা কয়েকমাস আগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটি প্রতিবেদন দিলেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এর আগে ছুটি শেষে নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে যোগদান না করায় ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) বিভাগের অধ্যাপক ড. বিকাশ চন্দ্র সিংহ এবং আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. জহুরুল ইসলামকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়।