Image description

২০২৩ সালের ১৬ জুন কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে নেওয়ার সময় জব্দ হওয়া সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণ চোরাচালান হয়ে দেশে ঢোকেনি বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

এই মামলার তদন্তে বেশকিছু বিষয় পাশ কাটিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে 'তথ্যগত ভুল' উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৩ সালে পিবিআই ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) মধ্যে মামলার তদন্তভার নিয়ে টানাপোড়েনের পর নতুন করে এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ায় বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে।

৭ কোটি ২২ লাখ টাকা মূল্যের ৮২০ ভরি স্বর্ণ জব্দের মামলায় গত বছরের ৭ এপ্রিল আসামিদের দায় অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন চট্টগ্রাম পিবিআই মেট্রো ইউনিটের পুলিশ পরিদর্শক মোজাম্মেল হক।

আদালতের নথি অনুযায়ী, চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর চলতি বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির কোনো আপত্তি না থাকায় মহানগর স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করেন। একইসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখিত ২৪ জন স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণ ফেরত দিতে আদেশ দেন আদালত।

মামলার এজাহার অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১৬ জুন কর্ণফুলী উপজেলার পুলিশ চেকপোস্টে যাত্রীবাহী বাস থেকে সাড়ে ৯ কেজি ওজনের স্বর্ণ জব্দ এবং ২ নারীসহ ৪ জনকে আটক করা হয়। পুলিশের ভাষ্য, কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে আসা স্বর্ণের চালান নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাচ্ছিলেন তারা। আটক করার সময় তারা পুলিশকে স্বর্ণের কোনো বৈধ কাগজ দেখাতে পারেননি। আটকের একদিন পর ১৭ জুন কর্ণফুলী থানায় ৪ জনকে আসামি করে মামলা করেন কর্ণফুলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোবারক হোসেন। জব্দ তালিকাও তিনি প্রস্তুত করেন।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—বসুন্ধরা ধর (৩৪), কৃষ্ণ ধর (৪০), নয়ন ধর ওরফে নারায়ণ (৩৮) এবং টিপু ধর ওরফে অলক (২৪)। তারা সবাই একই পরিবারের সদস্য। টিপু কক্সবাজারের স্বর্ণের কারিগর হিসেবে কাজ করেন। তারা সবাই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে জবানবন্দিতে টিপু ও নারায়ণ চট্টগ্রাম মহানগর বুলিয়ন সমিতির সভাপতি বিধান ধর ও কৃষ্ণ কর্মকার নামে দুই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নাম জানান।

মামলার তদন্তে চলাকালে বাপ্পু ধর নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তিনি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তার জবানবন্দি অনুযায়ী, এই বাপ্পুর কাছ থেকে সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণ নিয়ে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন ৪ জন।

আসামিদের মোবাইল ফোন কেন জব্দ হয়নি, তা উল্লেখ নেই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে

মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তৎকালীন কর্ণফুলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেহেদী হাসান। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে স্বর্ণ জব্দ করা হলেও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়নি। এমনকি মামলার বাদীর তৈরি করা জব্দ তালিকায় অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।

এ বিষয়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, যেকোনো ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্তের মোবাইল ফোন জব্দ করা তদন্তের সাধারণ অংশ। কারণ, মোবাইল ফোনে ডিজিটাল প্রমাণ থাকে, যা পরবর্তী সময়ে তদন্তে সহায়তা করে। স্বর্ণ চোরাচালানে যারা জড়িত, তারা পুলিশের নজর এড়াতে বিভিন্ন অ্যাপে যোগাযোগ করেন। কিন্তু, তদন্ত কর্মকর্তা মেহেদি হাসান সেসময়ে মোবাইল ফোনগুলো আসামিদের আত্মীয়দের কাছে দিয়ে দেন। ফলে আসামিদের ফোনের ফরেনসিক করতে পারেনি পুলিশ।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মামলা সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) বলেছেন, গ্রেপ্তার আসামিদের কললিস্ট পর্যালোচনায় ঘটনার আগে-পরে কোনোভাবেই কৃষ্ণ ধর ও বিধান ধরের যোগাযোগ না পাওয়ায়, আসামি বাপ্পু একা স্বর্ণগুলো গ্রহণ করেন ও সেগুলো ফেরত দিয়ে দেবেন স্বীকারোক্তি দেওয়ায় এবং বাপ্পুর জবানবন্দিতে কৃষ্ণ ও বিধানের নাম না বলায় মামলার ঘটনাটি 'তথ্যগত ভুল'।

এর আগে কর্ণফুলী থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) মেহেদী হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন জব্দ করা বাধ্যতামূলক নয়। আমি তাদের ফোন চেক করেছি এবং সেসময়ে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ও অন্যান্য কিছুতে সন্দেহজনক কিছু পাইনি। তাই পরবর্তী সময়ে এগুলো আসামিদের আত্মীয়দের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।'

'স্বর্ণের মালিকানার কাগজ নিয়ে প্রশ্ন'

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আইও উল্লেখ করেছেন, বাপ্পু স্বর্ণের কারিগর এবং আরএ শ্যামা জুয়েলার্সের মালিক। তাকে কক্সবাজারের ২৪ দোকানি এই সাড়ে ৯ কেজি গলানো স্বর্ণ নতুন করে অলংকার বানানোর জন্য দিয়েছেন। যা ৪ জনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হচ্ছিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২৪ জন দোকানি স্বর্ণ ফেরত দেওয়ার আবেদন করেন এবং তাদের ট্রেড লাইসেন্স, ডিলিং লাইসেন্স, ট্যাক্স রিটার্ন ও মেমো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারা সবাই স্বর্ণ ব্যবসায়ী। তারা স্বর্ণগুলো একত্রে বাপ্পুকে নতুন করে অলংকার বানাতে দিয়েছিলেন। জব্দ করা স্বর্ণ পুরাতন এবং তা গলানোর মাধ্যমে তা থেকে খাদ বের করে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পাঠানো হচ্ছিলো। যা স্বর্ণ চোরাচালান প্রমাণিত হয় না।

পিবিআই তদন্তের আগে এই মামলাটি কর্ণফুলী থানা পুলিশ ও সিএমপির ডিবি পুলিশ তদন্ত করেছিল।

পিবিআই তদন্তভার নেওয়ার আগে ৪ মাসে পুলিশ কিংবা ডিবির কাছে স্বর্ণের মালিকানা দাবি করে কেউ কোনো কাগজ জমা দেননি বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের একাধিক সূত্র। পিবিআই তদন্ত শুরু করার পর স্বর্ণের মালিকানার কাগজ আসা শুরু হয়।

এই মামলার তৎকালীন আইও ডিবি বন্দর জোনের এসআই রবিউল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার মামলার তদন্তের সময়ে স্বর্ণের মালিকানার কাগজ কিংবা কেউ কোনো আবেদন করেনি। সেসময় ১৬৪ ধারায় আসামি বিধান এবং কৃষ্ণ নাম আসায় তারা পলাতক ছিলেন।'

মামলার এজাহারেও উল্লেখ করা হয়েছে, জব্দ করা স্বর্ণের মালিকানার কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি কেউ।

আগে মামলা তদন্তে করেছেন এমন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী ও সক্রিয়। এরা ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। পাচারের সময় ধরা পড়লে তার ব্যাকআপ হিসেবে কাগজপত্র রেডি করা থাকে। ফলে এই সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের ধরা যায় না। দেশের বাইরে থেকে স্বর্ণগুলো পাচার হয়ে এসেছে এটি যেন না বোঝা যায়, তাই স্বর্ণ অনেক সময় গলিয়ে ফেলা হয়। ফলে এটি ধরার আর কোনো সূত্র থাকে না।

তারা আরও বলেন, আবার কাগজপত্রে সুবিধা করতে না পারলে শুধু বহনকারীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। কাগজপত্র সবকিছু এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হয়।

পিপি ও আইও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য

মোবাইল ফোন জব্দ না করার বিষয়, জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, মোবাইল জব্দ যে করা হয়নি এটা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বাদী সেটি জব্দ করেননি।

আদালতকে বিষয়টি জানিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আদালত জানতে চাননি, তাই জানাইনি। আসামিদের জবানবন্দি অনুযায়ী, একটা ক্লিয়ার ধারণা পাওয়া গেছে, এই স্বর্ণের উৎস ও মান নিয়ে। এই স্বর্ণগুলো দেশের অভ্যন্তরে ছিল, সেই জন্য মোবাইল ফোন ইস্যু নিয়ে আগানো হয়নি। আমরা সিডিআর নিয়েছি, কিন্তু কিছুই পাইনি।'

স্বর্ণের মালিক দাবি করা সবার দোকান থাকার পরও বাপ্পু ধরের কাছে একাধিকবার স্বর্ণ গলিয়ে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছেন কেন, এমন প্রশ্নে মোজাম্মেল বলেন, 'তিনি কক্সবাজার জেলার কারিগর। তার সুনাম আছে, তাই তাকে দেওয়া হয়েছে। এর আগেও একাধিকবার পরিবহনের জন্য তাকে দেওয়া হয়েছিলও। সেগুলোর অনুমতিপত্রও ছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'একজন তদন্ত কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় অনেক কিছু করতে পারে না। এখানে সিনিয়ররা আছেন। এটা একটি স্পর্শকাতর মামলা। পিবিআইয়ের সিডিউলভুক্ত মামলা এটি, তাই সব কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পিপির মতামতের ভিত্তিতেই এই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।'

মহানগর পিপি মফিজফুল হক ভূঁইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তো শুরু থেকেই এই মামলার বিষয়ে বলে আসছি। যাদের নাম এসেছে তাদের কেন গ্রেপ্তার না করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলো। আমি চিঠিও দিয়েছি সেসময়। তবে এই মামলার আর করার কিছুই নেই।'

প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে এই মামলার তদন্তভার সিএমপি ডিবিতে থাকার সময় তদন্তভার নিতে আগ্রহ দেখিয়ে সিএমপিতে চিঠি দেয় পিবিআই। সেসময় মামলা হস্তান্তর কোনো ইচ্ছা নেই জানিয়ে চিঠি দেন সিএমপির তৎকালীন কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়। টানাপোড়নের পর চাপের মুখে সেটি পিবিআইতে হস্তান্তর করে ডিবি পুলিশ।