Image description

দেশে গত এক সপ্তাহে দফায় দফায় ভূমিকম্প সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) নরসিংদীর মাধবদীতে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছিল সেটি ছিল স্মরণকালের ভয়াবহ ‍ভূমিকম্পের একটি। রাজধানীর এত কাছে এমন শক্তিশালী ভূমিকম্প নিকট অতীতে সংঘটিত হয়নি। এই ভূমিকম্পের পরই রাজধানীসহ আশপাশের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

দেশে ভূমিকম্পের শুরু গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎস ছিল নরসিংদীর মাধবদী। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। ওই ভূমিকম্পের পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট সাতবার ভূমিকম্প টের পেয়েছে দেশবাসী। ওই ভূমিকম্পে ১০ জন নিহত হয়। আহত হয় ছয়শ’র বেশি মানুষ। নরসিংদীতে ৫, ঢাকায় ৪ ও নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে কেউ কেউ ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন। অনেকেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন। ভূমিকম্পে কিছু ভবন হেলে পড়ে ও ফাটল দেখা দেয়।

এর একদিন পর, নরসিংদীতে আরও একটি মৃদু ভূমিকম্প হয়। জেলার পলাশ উপজেলায় সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ভূকম্পনটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩।

 

একই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। প্রথমটির উৎপত্তিস্থল রাজধানীর বাড্ডায়, দ্বিতীয়টির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে।

 

এরপর বুধবার দিবাগত রাত ৩টা ২৯ মিনিটে টেকনাফ থেকে ১১৮ কিলোমিটার দূরে ৪ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এ ভূমিকম্পে কেঁপেছে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ শহর।

 

এরপর রাত ৩টা ৩০ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে সিলেটে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৪। এটি মৃদু ভূমিকম্প হওয়ায় অনেকেই টের পাননি।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন জানান, দিবাগত রাত ৩টা ৩০ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৪ মাত্রার এ কম্পন অনুভূত হয়।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ১৫ মিনিটে কাঁপে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৬।

আজকের ভূমিকম্পের বিষয়ে আবহাওয়াবিদ রুবায়েত কবির বলছেন, সম্প্রতি যে ভূমিকম্প হয়েছে তারই আফটার শক এটি। এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, আজও ঘটনাক্রমে ভূমিকম্পের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে খুবই কাছে নরসিংদীর পলাশে। বেশিরভাগ ভূমিকম্পরেই উৎপত্তিস্থল হলো নরসিংদী। এই এলাকা হলো বার্মা প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল বা সাবডাকশন জোন। সিলেট ও টেকনাফে আজ যে ভূমিকম্প হয়েছে তাও এই সাবডাকশন জোনের অন্তর্ভুক্ত।

তিনি বলেন, নরসংদীর ভূমিকম্প মূলত ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে হয়েছে। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত এবং এগুলো ভূগর্ভস্থ তরলের ওপর ভাসমান অবস্থায় থাকে। প্লেটগুলো একে অন্যকে ধাক্কা দেওয়া, সরে যাওয়া বা ফাটলের সৃষ্টি করার মধ্য দিয়েই শক্তি সঞ্চিত হয়। যখন সেই শক্তি শিলার ধারণক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন ফাটল বা শিলাখণ্ডের হঠাৎ সরে যাওয়ার ফলে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।

হুমায়ুন আখতার বলেন, ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছিল, এটা স্মরণকালের মধ্যে দেশে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। এত তীব্রতা এর আগে আমরা কখনো অনুভব করিনি। স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার নগরবাসী সাংঘাতিক আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

বিশেজ্ঞরা বলছেন, নরসিংদী অঞ্চলে ১৯৫০ সালের পর থেকে ৫ দশমিক ৫ বা তার বেশি মাত্রার ১৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশের ভূমিকম্পের প্রধান দুটি উৎস— ডাউকি ফল্ট এবং সিলেট থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি দীর্ঘ ফল্ট জোন। দুটিই বিশেষজ্ঞদের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভূমিকম্পের কারণে বাংলাদেশের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল আরও শক্তি সঞ্চয় করেছে। তাই আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এর জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার কোনো বিকল্প নেই।

যদিও ভূমিকম্প কখন, কোথায় হবে—কেউই আগে থেকে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। কিন্তু কিছু সহজ প্রস্তুতি হিসেবে নিজের ঘরকে নিরাপদ রাখা, জরুরি সরঞ্জাম প্রস্ত্তত রাখা এবং জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে পূর্বপরিকল্পনা রাখার মতো বিষয়গুলি জীবন রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।

এর বাইরেও জনগণকে ব্যাপকভাবে সচেতন করে তোলা এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি রাখতে হবে। সঙ্গে নিয়মিত মহড়া এবং অবৈধ, অপরিকল্পিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করার ব্যবস্থা গ্রহণকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।