ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা সীমিত করে ভারত। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশের ভিসা সেন্টার ভারতে থাকায় সেসব দেশের ভিসা প্রাপ্তিতে দেখা দিয়েছে জটিলতা। এ ছাড়া বিগত কয়েক মাসে কঠিন হয়েছে মালয়েশিয়া, তুরস্ক, মিসর, ইন্দোনেশিয়াসহ বাংলাদেশি পর্যটকদের নিয়মিত গন্তব্যের দেশগুলোর ভিসা প্রাপ্তিও। এতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। যার প্রভাবে ধাক্কা লেগেছে সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত ভ্রমণকর সংগ্রহেও।
হজ, ওমরাহ এবং ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যতীত অন্য যেকোনো কাজে দেশের সীমানা পার হতে ভ্রমণকর পরিশোধ বাধ্যতামূলক। সেটি স্থল, রেল ও নৌপথ—সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আবার আকাশপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব ক্ষেত্রেই ভ্রমণকর দিতে হয় যাত্রীদের। ফলে কোনো কারণে ভ্রমণ কমলে এ খাত থেকে আয় কমে সরকারের।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে ভ্রমণকর বাবদ সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে প্রায় ১২৬ কোটি টাকা। কেবল গত নভেম্বর মাসেই আগের বছরের নভেম্বরের তুলনায় ভ্রমণকর আদায় কমেছে ৪৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, টাকায় যা প্রায় ৯৩ কোটি।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে ভ্রমণকর বাবদ সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ১৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা অক্টোবর মাসে এসে দাঁড়ায় ১৭৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর গত নভেম্বর মাসে ভ্রমণকর বাবদ সরকারের রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ১১৫ কোটি ২২ লাখ টাকা।
দেশের পর্যটনশিল্পের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রফিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণ কমে গেছে মূলত ভিসা প্রাপ্তি জটিল হওয়ার কারণে। যার প্রভাব পড়েছে সরকারের ভ্রমণকর আদায়ের ক্ষেত্রে। বর্তমানে ভারত ভিসা দিচ্ছে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম ভিসা দিচ্ছে না। ইন্দোনেশিয়া ভিসা ফি বাড়িয়েছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ভিসাপ্রাপ্তির হার কমে গেছে। দৈনিক মাত্র ৪০০ জন বাংলাদেশিকে ভিসা দিচ্ছে থাইল্যান্ড। এর পাশাপাশি আকাশপথে ভ্রমণে উড়োজাহাজের ভাড়া বাড়ার কারণেও পর্যটকেরা বিদেশভ্রমণ কমিয়েছেন।
বিদেশে কর্মী পাঠানো কমার করণেও ভ্রমণকর আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে টোয়াব সভাপতি বলেন, সৌদি আরব ছাড়া বাকি দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে না। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও বাহরাইন এ মুহূর্তে বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা দিচ্ছে না। ফলে কর্মী ভিসায় বিদেশগমনও কমেছে। যার প্রভাব পড়ছে সরকারের ভ্রমণকর আদায়ে। তিনি বলেন, অতীতে বিদেশভ্রমণ কমলে দেশের ভেতরে পর্যটকদের ভ্রমণ বাড়ত। এবার সেটিও আশানুযায়ী হচ্ছে না।
কারণ, সেন্ট মার্টিন, পার্বত্য এলাকাসহ একাধিক গন্তব্যে বিধিনিষেধ থাকায় পর্যটকেরা আগ্রহ হাচ্ছেন।
টোয়াব সূত্র বলছে, ভ্রমণ, চিকিৎসা, ব্যবসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বিদেশভ্রমণে যায়। যার মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশির গন্তব্য থাকে ভারত। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ৯ মাসে (ফেব্রুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ভারতে ভ্রমণ করা বিদেশি পর্যটকের মধ্যে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশিরা, যা গত অক্টোবরে এসে পৌঁছায় দ্বিতীয় অবস্থানে। গত সেপ্টেম্বরে ভারত ভ্রমণে গিয়েছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৬২ বাংলাদেশি। এ সংখ্যা গত অক্টোবরে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৮ জনে।
খাতসংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, গত কয়েক মাসে যাঁরা ভারত ভ্রমণ করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগের ভিসাই আগে ইস্যু করা। বর্তমানে ভারতের ভিসা সীমিত থাকায় সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশি পর্যটকের বিদেশযাত্রা আরও কমবে। ফলে কমে যাবে ভ্রমণকর বাবদ রাজস্ব আয়ও।
এদিকে সরাসরি ভিসা বন্ধ না করলেও বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আবেদন প্রত্যাখ্যান করছে অনেক দেশ। ভিসা প্রসেসিং সহায়তাকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, বর্তমানে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া আগের মতো ভিসা দিচ্ছে না। প্রায় ৮০ শতাংশ ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করছে তুরস্ক, মিসর, ভিয়েতনামও। থাইল্যান্ডের ভিসা পেতে অনেক সময় ৪৮ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। ভিসা ফি বাড়িয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কা।
শিক্ষার্থী ভিসায় প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায়। তবে ইউরোপের বেশ কিছু দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের ভিসা সেন্টার বাংলাদেশে নেই। এসব দেশের ভিসা নিতে হলে ভারতে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিতে হয়। কিন্তু ভারতের ডাবল এন্ট্রি ভিসা প্রাপ্তির হার কম হওয়ায় শিক্ষার্থীরাও কাঙ্ক্ষিত দেশে যেতে পারছেন না।
এদিকে যাত্রী কম থাকায় ভারতগামী সাপ্তাহিক ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে এনেছে দেশীয় এয়ারলাইনসগুলো। ভিসা বন্ধ হওয়ার পরপরই গত বছর কলকাতা রুটের ফ্লাইট বন্ধ করে বেসরকারি আকাশ পরিবহন সংস্থা নভোএয়ার। আরেক বেসরকারি উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস ভারতগামী সাপ্তাহিক ফ্লাইট ৩২ থেকে ১০টিতে নামিয়ে এনেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসও ভারতে ফ্লাইট কমিয়েছে। গত জুলাই মাসেও এয়ারলাইনসটির ভারতে সপ্তাহে ৫৯টি ফ্লাইট ছিল, যা গত নভেম্বর মাসে কমে দাঁড়িয়েছে সাপ্তাহিক ২৮টিতে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম জানান, ভারত ভিসা দেওয়া বন্ধ করায় যাত্রী কমেছে। এ জন্য ফ্লাইটসংখ্যা কমানো হয়েছে।