‘সমাজকর্মে পড়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক, স্নাতকের আগেই স্নাতকোত্তর’ শিরোনামে গত ২ নভেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ হয় দৈনিক কালবেলায়। যাতে তুলে ধরা হয় যশোর সদর উপজেলার মাহিদিয়া সম্মিলনী মহিলা আলিম মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগে ভয়াবহ জালিয়াতির সব তথ্য। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা তদন্তে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ থেকে গঠন করা হয় একটি কমিটি। কিন্তু সেই কমিটিরই সদস্যরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বাঁচাতে মরিয়া—এমন অভিযোগ আসার পর জালিয়াতি উদ্ঘাটনে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আলাদা আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে, চার শিক্ষকের এমপিওভুক্তিতে জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, চারজনের মধ্যে দুজনের এমপিও শিটে নাম এক, কিন্তু তারা বেতন তুলছেন অন্য নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে। যার প্রমাণও মিলেছে।
এ ছাড়া জালিয়াতির অনুসন্ধানে গঠিত কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের বাঁচাতে পুরো ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় দিতে নানা ধরনের ছলচাতুরীর প্রমাণ পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্ত চলছে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের তৈরি করা ‘স্ক্রিপ্টে’। ঘুষ লেনদেন করা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফারুক হোসাইন নিজেই সেই স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী দিচ্ছেন সাজানো বয়ান। শুধু তাই নয়, তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করছেন কমিটি আর অভিযুক্তরা মিলেমিশে। তদন্ত কর্মকর্তার কক্ষে সারাক্ষণ বসে থাকেন অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা উপপরিচালক (অর্থ) ড. শফিকুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক ইসমাইল হোসেন। একই সঙ্গে বেতন ছাড় করতে শিক্ষকরা আর্থিক লেনদেন করেছেন—এমন প্রমাণও মিলেছে অনুসন্ধানে।
তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভিন্ন উপায়ে মাহিদিয়া সম্মিলনী মহিলা আলিম মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগে জালিয়াতির তদন্ত করাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) দুজন পরিদর্শক দিয়ে আলাদাভাবে করছে এই তদন্ত।
জানতে চাইলে ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক এম এম সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কালবেলায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ওই মাদ্রাসার নিয়োগ ও অন্যান্য বিষয় তদন্তের জন্য একটি টিম পাঠানো হয়েছে। তারা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। কমিটি শিক্ষক নিয়োগের সব বিষয় খতিয়ে দেখার পর মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য ও ডিআইএ-এর শিক্ষা পরিদর্শক নূশরাত হাছনীন কালবেলাকে বলেন, ‘ওই মাদ্রাসার তদন্তে আমরা এখন যশোরে আছি।’
গত ২ নভেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওই মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের আরও ভয়াবহ কিছু জালিয়াতির তথ্য এসেছে কালবেলার হাতে। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর যে চারজনের বেতন ছাড় করেছে গত জুলাই মাসে তাদের বেতন ব্যাংকে যায়। এর মধ্যে এমপিও শিটে এক নামে বেতন হলেও ব্যাংক থেকে তা তুলছেন একেবারে ভিন্ন নামে। মুস্তাকের নামে এমপিও হলেও ব্যাংকে টাকা যাচ্ছে মুরাদ নামের অ্যাকাউন্টে। আবার আমেনার নামে হওয়া বেতন ব্যাংক থেকে তোলা হচ্ছে আসমা নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে। জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া চার শিক্ষকের এমপিও ছাড়, জাল সনদ, ঘুষ লেনদেন ও পরিচয় জালিয়াতির অগণিত প্রমাণ সামনে আসার পরও তদন্ত কমিটি এখন অভিযুক্তদের বাঁচাতে ‘স্ক্রিপ্টেড’ তদন্তে ব্যস্ত—এমন অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।
অনুসন্ধান বলছে, সবচেয়ে বড় জালিয়াতি করেন রসায়নের প্রভাষক মুস্তাক আহমেদ। তিনি প্রকৃতপক্ষে মুস্তাক নন, তার আসল নাম মুরাদ। এমপিওশিটে মুস্তাক আহমেদ হলেও তার নামে থাকা যশোর রূপালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর 3046…5943 থেকে ২০২০ সালের জুন মাস থেকে বেতন তুলছেন মুরাদ হোসাইন নামে। তার নিজের কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নেই। একসময় একই মেসে থাকা মুস্তাক আহমেদের অনার্স সনদ এবং মাস্টার্সে মাসুম পারভেজ নামে আরেক ব্যক্তির সমাজকর্ম বিভাগের সনদ টেম্পারিং করে ব্যবহার করেছেন। মজার তথ্য হলো, এই যে সনদ জমা দিয়েছেন তাতে অনার্স পাস করার দুই বছর আগেই মাস্টার্স পাস করেছেন—এমন তথ্য উল্লেখ রয়েছে। প্রকৃত মুস্তাক ২০২১ সাল থেকে মধুপুর বাহাদুরপুর মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক (ভৌত বিজ্ঞান) হিসেবে কর্মরত আছেন—এমন তথ্য পেয়েছে কালবেলা।
এমপিও শিটে সহকারী মৌলভি হিসেবে নাম রয়েছে আমেনা খাতুনের। তিনি মূলত আসমা থেকে আমেনা নাম ধারণ করেছেন। আমেনা নামে থাকা যশোর রূপালী ব্যাংক করপোরেট শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বর 30460…5710 থেকে বেতন তুলছেন আসমা খাতুন। এই আসমা খাতুন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফারুক হোসেনের তৃতীয় স্ত্রী। চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তাকে বিয়ে করেন অধ্যক্ষ। আরেক নারী শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক শারমীন আক্তার ব্যবহার করছেন পুরুষ প্রার্থীর শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ। এরপর আমেনা খাতুন নামে অন্য আরেকজনের কামিল পর্যন্ত সনদ এবং নামের মিল থাকা আমিনা খাতুন নামে আরেকজনের বিএডের জাল সনদ ব্যবহার করে আসমা খাতুনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ ও এমপিওভুক্ত করা হয়। গণিতের প্রভাষক তরিকুল ইসলাম তো আরেক ধাপ এগিয়ে আছেন। তিনি তার বন্ধুর সব সনদ ব্যবহার করে হয়েছেন শিক্ষক। তবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিজের নাম ঠিক রাখতে শুধু তার এনআইডি ব্যবহার করেছেন। আর শারমিন আক্তার তো পুরুষের শিক্ষক নিবন্ধনের সনদ ব্যবহার করেছেন।
অভিযুক্তদের স্ক্রিপ্টে চলছে তদন্ত: ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে ওই চার শিক্ষকের বেতন ছাড় করা হয়েছে—এমন তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও কমিটির সদস্যরা নিজেরাই এখন একটা পক্ষ হয়ে অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তদন্ত করছেন মাদ্রাসা অধিদপ্তরের দুই পরিচালক এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের উপসচিব রাহাদ মান্নান।
সূত্র বলছে, তদন্ত চলছে অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তার তৈরি করা স্ক্রিপ্টে। তাদের কথামতো বয়ান দিচ্ছেন অধ্যক্ষ। আবার ফারুকের আনা ভুয়া সাক্ষীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে লিখিত বয়ান। শুধু তাই নয়, যার অভিযোগে প্রথম এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন জেলা প্রশাসক সেই অভিযোগকারীই এখন অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা অধ্যক্ষকে ভয় দেখাচ্ছেন তাদের কথা মতো বয়ান না দিলে বেতন-ভাতা ফের বন্ধ করে দেওয়া হবে। শুনানিতে অধ্যক্ষ ও অভিযুক্ত শিক্ষকরা যে লিখিত বক্তব্য দিচ্ছেন, তা মুহূর্তেই অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তার কাছে চলে যাচ্ছে। একই রুমে বসে তদন্ত করছেন অভিযুক্ত ও তদন্ত কমিটির লোকজন। তদন্ত কমিটি নথি/কাগজপত্র/ফাইল ওয়ার্ক না করেই ফারুকের তৈরি বয়ানে চালাচ্ছে তদন্ত। এটা হাস্যকরও বটে। শুধু তাই নয়, তদন্ত প্রতিবেদন লিখছেন মিলেমিশে—এমন অভিযোগও উঠেছে।
অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, তদন্ত কমিটি কাকে কীভাবে জিজ্ঞাসা করবে সেই ‘স্ক্রিপ্ট’ লিখে দিচ্ছেন অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা। মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার নির্দেশে চলছে সেই তদন্ত কমিটি। কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রাহাত মান্নানের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে অভিযুক্ত উপপরিচালক শফিকুল ইসলামের। এই রাহাত মান্নান তদন্ত প্রতিবেদন ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ঘুষ লেনদেন হয় যেভাবে: যে চার শিক্ষকের বেতন ছাড় করা হয়েছে তার মধ্যে শারমিন আক্তার রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রভাষক। তিনি যে নিবন্ধন সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন সেটি মূলত একজন পুরুষের। এ বিষয়ে শারমিন তার এক সহকর্মীকে বলেন, ‘অধ্যক্ষ ফারুক আমার কাছ থেকে ধাপে ধাপে এখন পর্যন্ত ২২ লাখ টাকা নিয়েছে। এবার বেতন ছাড় করতে আরও ১৪ লাখ টাকা চেয়েছে; কিন্তু এতো টাকা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় বিধায় ব্যাংকের চেক লিখে দিয়েছি। যখন বেতন ছাড় হবে তখন তিনি তুলবেন এবং অধ্যক্ষ তাই করেছেন। অধ্যক্ষ আমাকে প্রতিনিয়ত বাসায় গিয়ে হুমকি দিচ্ছে। মাদ্রাসায় কোনো তদন্ত দল এলেই দল বেঁধে সবসময় চাঁদা দিতে হয়। কখনো অধ্যক্ষ নিজে নেয় আবার কখনো অধ্যক্ষের পক্ষে মুরাদ (মুস্তাক) নেয়।’
কালবেলার অনুসন্ধানের পর এক তরিকুলের নামে অন্য তরিকুল চাকরি করার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে এলাকায় হৈ চৈ শুরু হয়। রাগে ক্ষোভে প্রকৃত তরিকুল পিটুনি দেয় অধ্যক্ষ ফারুককে। প্রকৃত তরিকুল বলেন, ‘চারজন ভুয়া শিক্ষকের বেতন ছাড় করার কারণে এলাকার মানুষ বলাবলি করত অধ্যক্ষ ফারুক পারে না এমন কোনো কাজ দুনিয়ায় নেই। ফারুক একজন প্রতারক, বাটপার। সে আমার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। জুলাই বিপ্লবের আগে সে তাঁতী লীগ, পরে জামায়াতের রুকন, আর বর্তমানে বিএনপিতে যোগদান করেছেন।’
এমন অভিযোগ স্বীকার করে অধ্যক্ষ ফারুক হোসাইন কালবেলাকে বলেন, ‘আমি চাকরি করি। যখন যে সরকার আসবে তখন সে সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনীতি করতে হয়।’
অনুসন্ধানে ইসমাইলের সঙ্গে অধ্যক্ষ ফারুকের লেনদেন হয়েছে—এমন তথ্য পাওয়া গেছে। অধ্যক্ষ ফারুক কালবেলাকে বলেন, ‘বেতন-ভাতা ছাড় করতে ঘুষ দিতে হয়। সেই ঘুষ আমরা দিয়েছি; কিন্তু কোনো ডকুমেন্ট রাখেনি।’
সহকারী পরিচালক ইসমাইলকে বেনাপোল থেকে উপঢৌকন পাঠান আলোচিত এই চার শিক্ষক। সেটার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন অধ্যক্ষ। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘একজন অফিসার আমাদের কাজ করে দিয়েছেন, সেজন্য সামান্য কিছু উপহার দেওয়া হয়েছে, এটা দোষের কিছু না।’
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত এক পরিদর্শক বলেন, ‘এটা শুধুই তদন্তের নামে একটা অভিনয় চলছে। ইসমাইল সারা দিনের পাঁচ মিনিটও তার ডেস্কে বসে না। সারা দিন বসে থাকে পরিচালকদের রুমে। আর শফিক অধিদপ্তর চালাচ্ছে, তাদের আবার কী হবে?’
ওই মাদ্রাসার তিনজন শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, ফারুকের সব জালিয়াতির কাজের সহযোগী সুপার কামরুল, রসায়নের শিক্ষক মুস্তাক (মুরাদ) ও দালাল মাহাবুজ্জামান। এই চার শিক্ষকের বেতন ছাড় করতে অধ্যক্ষ ৫০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন। সব জেনেও যে কর্মকর্তারা এই চারজনের বেতন ছাড় করেছে তাদের শাস্তি হওয়া দরকার।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ ফারুক বলেন, ‘তরিকুলের হয়তো এনটিআরসি সনদ নেই, তবে সে এমএসসি পাস। ভালো ছাত্র। প্রকৃত তরিকুলের চেয়ে সে অনেক মেধাবী।’
মুস্তাক মাস্টার্সে যে সনদ ব্যবহার করেছেন সেই সনদের প্রকৃত অধিকারী মাসুম পারভেজ। এ বিষয়ে মাসুম পারভেজ বলেন, ‘আমি শুধু আমার একাডেমিক সনদ অধ্যক্ষ ফারুককে দিয়েছি। অবশিষ্ট যা যা ভুয়া কাগজ তৈরি করার সব করেছে ফারুক।’
মাদ্রাসার অবৈধ এসব নিয়োগ ও এমপিওভুক্তিতে অধ্যক্ষ ফারুককে সহায়তা করেছেন তৎকালীন উপজেলা মাধ্যমিক অফিসার কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ও মুস্তাক (মুরাদ) এবং উপাধ্যক্ষ মালেক। নিয়োগের প্রার্থী সংগ্রহ ও কাগজপত্র তৈরিতে সহায়তা করেছেন যশোর সদরের বসুনদিয়া মডেল দাখিল মাদ্রাসার সুপার কামরুল ইসলাম।