Image description

ভূমিকম্পে প্রাণহানি রোধে সরকারকে অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ জনসমাগমপ্রবণ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ সব ভবন ও স্থাপনার সক্ষমতা যাচাইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও ভূতত্ত্ববিদরা।

আজ রোববার দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত 'ঢাকার জন্য সতর্কবার্তা: ভূমিকম্প ঝুঁকি ও জননিরাপত্তা' শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এ আহ্বান জানান তারা।

বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, 'ভবনের সক্ষমতা যাচাই একটি বড় ও দীর্ঘমেয়াদী কাজ। কিন্তু এর মধ্যেও জনসমাগম বেশি হয় এমন স্থান—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো অবিলম্বে পরীক্ষা করা উচিত।'

তাৎক্ষণিক যাচাই ও ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, 'সরকারি ভবনগুলো সরকারিভাবেই পরীক্ষা করতে হবে, আর বেসরকারি ভবন মালিকদের বাধ্য করতে হবে পরীক্ষা করাতে। এটা এখনই করা সম্ভব, যা ঝুঁকি কমাবে।'

বুয়েটের এই অধ্যাপক হাসপাতালের প্রস্তুতি মূল্যায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। বলেন, 'স্বল্প সময়ের মধ্যেই কর্তৃপক্ষকে জানতে হবে আমাদের কতগুলো হাসপাতাল আছে, কতটি শয্যা রয়েছে এবং কোন ধরনের রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা তাদের আছে। কেননা ভূমিকম্পের পর হাসপাতালগুলোকে নিয়মিত রোগীদের পরিবর্তে আহতদের চিকিৎসা দিতে হবে।'

হাসপাতালের প্রস্তুতির বিষয়টি তুলে ধরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইন্টেইনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম বলেন, '৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ২ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ও ৪ লাখ আহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা এদের চিকিৎসা করব কীভাবে? হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখতে হবে, কিন্তু ৪০ শতাংশ হাসপাতাল ভবনই ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে থাকতে পারে। আমাদের ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণ করা দরকার।'

অধিক প্রাণহানি এড়াতে তিনি 'গোল্ডেন আওয়ার'-এর গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, 'আমাদের রাস্তা সচল রাখতে হবে, জরুরি প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং সব সংস্থাকে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনে সমন্বয় করতে হবে। ফিল্ড হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক, বিদ্যুতের ব্যাকআপ, অক্সিজেন ও প্রাথমিক চিকিৎসার সুবিধা থাকতে হবে।'

ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের বিকল্প রুট—হেলিকপ্টার ওঠা-নামার স্থান ও জলপথ চিহ্নিত করতে হবে, কারণ স্থলপথের ৬০ শতাংশই অচল হয়ে যেতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী, স্বাস্থ্যখাত, স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনকে সম্পৃক্ত করে একটি জাতীয় ভূমিকম্প মহড়ার প্রয়োজন—যা আগে কখনও হয়নি।'

ভবন মজবুতিকরণের মাধ্যমে মানুষের জীবন রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, 'আমাদের এখনই ভবনের সক্ষমতা যাচাই শুরু করতে হবে এবং ৬–৯ মাসের মধ্যেই শেষ করতে হবে। কেননা রেট্রোফিটিং করতে সময় লাগবে। যারা উঁচু ভবনের নকশা করেন, তাদেরই এর রক্ষণাবেক্ষণ তদারকি করতে হবে। বর্তমানে নকশাকারীরা নকশা হস্তান্তর করেন আর ঠিকাদারেরা নিজেদের মতো করে ভবন নির্মাণ করেন।'

একটি গবেষণার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, তারা ৭ হাজারেরও বেশি কারখানা ও স্কুল ভবন মূল্যায়ন করেছেন, যার ৪০ শতাংশেই সমস্যা পাওয়া গেছে।

এই ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ বলেন, 'প্রতিটি ভবন আলাদাভাবে পরীক্ষা করতে হবে, কারণ পাশাপাশি থাকা ভবনের গুণগত মানেও পার্থক্য থাকতে পারে। জাপান ও ভারতের মতো দেশে তৃতীয় পক্ষ দিয়ে মূল্যায়ন করানো হয়, বাংলাদেশেও তা করা উচিত। ঢাকার ২১ লাখ ভবনের মূল্যায়ন রাজউকের একার পক্ষে সম্ভব নয়।'

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, ৬ তলা একটি ভবনের মূল্যায়নে খরচ হয় ২ লাখ টাকা, আর রেট্রোফিটিং করতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা—যা ভবনধস, উদ্ধারকাজ ও প্রাণহানির খরচের তুলনায় অনেক কম।

প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ভূমিকম্প শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. বদরুদ্দোজা মিয়া বলেন, 'জাপানে শিশুরা স্কুল থেকেই আর্থ সায়েন্স শেখা শুরু করে। সেখানে শেখানো হয় ভূমিকম্প কী, কীভাবে ঘটে এবং ভূমিকম্প কেন একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক ঘটনা। তারা শেখে ভূমিকম্পের আগে, ঘটার সময় ও পরে কী করতে হবে।'

তিনি প্রস্তাব করেন, বাংলাদেশে কমিউনিটি, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আর্থ সায়েন্স শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা আর্থ সায়েন্স পড়ে, কিন্তু তারা দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম—ফলে অধিকাংশ মানুষই এ বিষয়ে অজ্ঞাত থাকে।

'সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা চতুর্থ তলা থেকে লাফ দিয়েছে। এটা কখনোই হওয়া উচিত নয়। পৃথিবীর কোথাও ভূমিকম্পের সময় মানুষ এমন কাজ করে না। জ্ঞানের অভাবেই এই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে', বলেন তিনি।

অধ্যাপক বদরুদ্দোজা মিয়া বাংলাদেশে একটি স্বতন্ত্র ভূমিকম্প গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, যেখানে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যথাযথ প্রণোদনা নিয়ে ভূকম্পনবিদ্যায় গবেষণা করতে পারবে।

তিনি বলেন, 'দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে প্রকৃত ভূকম্পবিদ নেই। অনেক শিক্ষার্থী গবেষণার জন্য বিদেশে যায়, আর যারা থাকে তারা চাকরি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বাংলাদেশে গবেষণাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।'

ঢাকায় নির্মাণ-প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, 'মানুষ নিচু জমি ও জলাধার ভরাট করে প্লট বানাচ্ছে, সরু রাস্তা তৈরি করছে এবং তার পাশে বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করছে। কিন্তু কাঠামোগত মান, মাটির অবস্থা, জমির স্থায়িত্ব, সঠিক নকশা—এসব কিছুই বিবেচনা করা হয় না।'

রাষ্ট্রের অবহেলার সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'যেসব সংস্থা ভবনের কাঠামো ও ভূমির গুণগত মান তদারকির দায়িত্বে আছে, তারা অত্যন্ত অবহেলাপরায়ণ। বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি ২০২০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করলেও এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। শুধু ঢাকা নয়—সারা দেশেই ভবনের গুণগত মান কেউ তদারকি করছে না।'

রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ হেলালী সতর্ক করে বলেন, 'রাজউকের আওতাধীন এলাকার ২১ লাখ ভবন বিবেচনা করলে প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে, আর প্রকৌশল নকশা অনুযায়ী নির্মিত ৬ লাখ ভবনের মধ্যেও ৭৫ হাজার ভবন বড় ভূমিকম্পে ধসে পড়তে পারে। এতে সম্ভাব্য প্রাণহানির সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার থেকে ৩ লাখ ১০ হাজার, আহত ২ লাখ থেকে ৫ লাখ ৫০ হাজার, সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি ২৫ বিলিয়ন ডলার এবং পুনর্নির্মাণ ব্যয় ৬২ বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।'

তিনি জানান, চলমান মূল্যায়নে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালসহ ৩ হাজার ২৫২টি ভবন পরীক্ষা করা হচ্ছে। ৪২টি ভবন ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে, আর ২০০টি ভবন রেট্রোফিটিংয়ের উপযোগী—কিন্তু প্রকল্পে বিলম্বের কারণে কাজ আটকে আছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন দুর্যোগ প্রস্তুতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে।

উদাহরণ হিসেবে জানান, রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে ডিএসসিসি একটি ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার স্থাপন করেছে—যা দেশে সবচেয়ে সক্রিয় কেন্দ্র।

ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, 'যেহেতু ভূমিকম্প খুবই বিপজ্জনক এবং আগে থেকে এর কোনো পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। সেহেতু গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ভূমিকম্প নিয়ে জনগণকে সচেতন করা, বিশেষ করে নীতি নির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।'

তিনি বলেন, 'ভূমিকম্প নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু কিছুদিন পর নীতিনির্ধারকেরা এসব ভুলে যান।'

মাহফুজ আনাম আরও বলেন, 'বিশেষজ্ঞদের মতো নীতি প্রণয়নের দক্ষতা আমাদের নেই। আমাদের সক্ষমতা হলো জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়া। এই জায়গা থেকে অনুরোধ করছি যে, আপনারা যারা স্কলার আছেন এবং আমরা যারা গণমাধ্যমকর্মী আছি, তারা যৌথভাবে মিলে সত্যিকারের কিছু একটা করতে পারি কিনা?'