নিজ জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন সাধারণত নিষিদ্ধ। কিন্তু জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবদুল আউয়ালের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মোটেই কার্যকর হয়নি আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে, এমনকি এ সরকারের আমলেও। নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে নির্বাহী প্রকৌশলী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (চ. দা.) উভয় পদেই তিনি দীর্ঘকাল নিজ জেলায় পদায়নে থেকেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে করেছেন আওয়ামী এমপির ক্ষমতা ব্যবহার, আর এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়েছেন সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর। প্রকৌশলী আউয়াল গড়ে তুলেছিলেন বড় আকারের দুর্নীতির সিন্ডিকেট। কথিত ভাতিজাকে সামনে রেখে আদতে তিনি নিজেই অবৈধ প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারি ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছেন দীর্ঘকাল ধরে। আর এর মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অংকের অর্থ। সম্পদ গড়েছেন দেশে এবং বিদেশে। অবশেষে বড় অংকের টাকায় বাগিয়ে নিলেন প্রধান প্রকৌশলী পদ। গত ১৭ নভেম্বর মো. আব্দুল আউয়ালকে প্রধান প্রকৌশলী পদের রুটিন দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এতে তিন জন সিনিয়র প্রকৌশলীকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে যে, শীর্ষ দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে প্রধান প্রকৌশলী পদটি কিনে নিয়েছেন। সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর ঘনিষ্ঠ বিশেষ একজন দালালের মাধ্যমে এই অর্থের লেনদেন হয়েছে। অথৈর লেনেদেন সম্পন্ন হওয়ার পরই অত্যন্ত দ্রুত গতিতে নথি উপস্থাপিত হয় বলে জানা যায়।
প্রকৌশলী আউয়াল জ্যেষ্ঠতা তালিকায় বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে চতুর্থ। এছাড়া প্রকৌশলী আব্দুল আউয়ালের বিরুদ্ধে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে স্থানীয় এমপির সঙ্গে যোগসাজশে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোসহ সিন্ডিকেট দুর্নীতিরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে গত মে মাসে যেসব কর্মকর্তার বিষয়ে এনএসআই (ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স) এর মূল্যায়ন প্রতিবেদন চাওয়া হয় তারমধ্যে মো. আব্দুল আউয়ালের নাম ছিল না। গত ২৫ মে ৫ জন কর্মকর্তার বিষয়ে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন চাওয়া হয়। তারমধ্যে প্রথম নাম ছিল প্রকৌশলী মীর আব্দুস সাহিদের। এনএসআই’র ওই মূল্যয়ন প্রতিবেদন আসার পর মীর আব্দুস সাহিদকেই প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্বে) করা হয়। চাকরির বয়স শেষে গত ১১ নভেম্বর মীর আব্দুস সাহিদ অবসরে যান। ওই তালিকার আরো একজন অবসরে গেছেন ইতিমধ্যে। অর্থাৎ তালিকার এখনো তিনজন কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। এই তিন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মো. আব্দুল আউয়ালকে প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্বে) করা হলো। যদিও প্রকৌশলী আউয়ালের অতীত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কোনো মূল্যায়ন প্রতিবেদন চাওয়া হয়নি বা নেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সরকারের এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা- বিশেষ করে এনএসআই’র মূল্যায়ন প্রতিবেদন নেওয়াটা অপরিহার্য। কখনো কখনো এসব ক্ষেত্রে এসবিসহ আরো একাধিক সংস্থা থেকেও মূল্যায়ন প্রতিবেদন নেওয়া হয়ে থাকে। এটা করা হয় এজন্য যে, চাকরি সংক্রান্ত নথিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বাস্তব কর্মকাল সম্পর্কে অনেক কিছুই উল্লেখ থাকে না, যা শীর্ষ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য অপরিহার্য। গোয়েন্দা সংস্থাসমুহের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাড়া এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রকৌশলী আব্দুল আউয়ালের বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন চাওয়া হয়নি বা নেওয়া হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়ন প্রতিবেদন ছাড়াই তাকে প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্বে) পদে নিয়োগ দেওয়া হলো, তাও কর্মরত সিনিয়র তিনজন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে।
সূত্রমতে, এক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বড় অংকের টাকা লেনদেন। তাই আব্দুল আউয়ালকে প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগের সময় মূল্যায়ন প্রতিবেদন চাওয়ার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। মূল্যায়ন প্রতিবেদন চাওয়া হলে নিশ্চিতভাবেই তার বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন আসতো।
প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী উভয়েই ময়মনসিংহ জেলার। আব্দুল আউয়াল দীর্ঘদিন ধরে নিজ জেলায় কাজ করার সুবাদে একটি শক্তিশালী দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এরসঙ্গে রাজনীতির প্রভাবও যুক্ত হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আশরাফপুর গ্রামের। নিজেকে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন বরাবর। তৎকালীন আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক, ময়মনসিংহ-৮ (ইশ্বরগঞ্জ) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আব্দুস সাত্তার ছিলেন আউয়াল সিন্ডিকেটের অন্যতম ব্যক্তি। এমপি আব্দুস সাত্তারের প্রভাব খাটিয়ে প্রকৌশলী আউয়াল ২০১৭ সালে নরসিংদী থেকে নিজ জেলা ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীতে চলতি দায়িত্বে সিলেট বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে দেড় বছর দায়িত্ব পালন করার পরপরই, তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সহযোগিতায় আবারও নিজ জেলা ময়মনসিংহ সার্কেলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে প্রায় পাঁচ বছর যাবত তিনি এখানেই কর্মরত আছেন। সরকারি এই পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিজ জেলায় এভাবে লাগাতার দীর্ঘকাল কর্মরত থাকার ঘটনা নজিরবিহীন।
ময়মনসিংহে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে টেন্ডার বাণিজ্য, কমিশন গ্রহণ থেকে শুরু করে নিজেই ঠিকাদারি সহ নানা ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল। এর আগে নরসিংদীর নির্বাহী প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় সেখানেও ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ঘুষের বিনিময়ে তা ধামাচাপা দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায়। একই জেলায় বাড়ি হওয়ায় সচিবের আশীর্বাদে প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল এই আমলেও আবার হঠাৎ ক্ষমতাবান হয়ে উঠেন। পুরনো সিন্ডিকেট আবার নতুন করে গড়েন। নিজের এলাকার লোক- এ কথা বলে উপদেষ্টাকে রাজি করিয়ে আব্দুল আউয়ালকে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেয়ার ব্যবস্থা করেন সচিব। কিন্তু বাস্তবে এর পেছনে রয়েছে ৫ কোটি টাকার লেনদেন।
শীর্ষনিউজ