Image description

নিউ ইস্কাটনস্থ বিয়াম (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট) ফাউন্ডেশন ভবনে বিস্ফোরণ ও ধ্বংসযজ্ঞকে পরিকল্পিত বলে তথ্য উদঘাটন করেছে পিবিআই। প্রাথমিক তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গত ২৮ জুলাই এ তথ্য জানায়। পিবিআই’র উদঘাটিত তথ্যে বলা হয়, এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত অগ্নিসংযোগ। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিসিএস প্রশাসন কল্যাণ সমবায় সমিতির গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে দেয়া। ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেফতারও করা হয়। তাদের জবানবন্ধীতে ঘটনা যে পরিকল্পিত এর বিবরণ বেরিয়ে আসে। কিন্তু এরপরে তদন্ত আর এগোয়নি মোটেই। এদিকে ঘটনার শুরুতে বিসিএস প্রশাসন কল্যাণ সমবায় সমিতির কর্মকর্তারা এরজন্য সরাসরি বসুন্ধরা গ্রুপকে দায়ী করলেও এখন তারা বোল পাল্টে ফেলেছেন। বলছেন, বসুন্ধরা গ্রুপ এটা করেনি। তবে কে করেছে, এর জবাবও তারা দিচ্ছেন না। শীর্ষনিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজের পক্ষ থেকে পাল্টা এ প্রশ্ন করা হলে অন্য কথা তুলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন সমিতির নেতারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে বিসিএস প্রশাসন কল্যাণ সমবায় সমিতির নেতাদের ইতিমধ্যে গোপন সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে বসুন্ধরা গ্রুপকে ছাড় দিচ্ছেন সমিতির নেতারা। বসুন্ধরা গ্রুপের একের পর এক চুক্তিভঙ্গের কারণে সমিতির সদস্য, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অনেক আগে অর্থ পরিশোধের পরও প্লট পাচ্ছেন না। দীর্ঘকাল ধরে প্লটের জন্য ঘুরছেন। এখন পর্যন্ত একটি প্লটও সরেজমিনে বুঝিয়ে দিতে পারেনি কল্যাণ সমিতি। জমি ক্রয় এবং মাটি ভরাট বিষয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে পর পর ৫টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রত্যেকটি চুক্তিই লঙ্ঘন করেছে এই প্রভাবশালী আওয়ামী ব্যবসায়ী গ্রুপটি। ৫ আগস্ট, ২০২৪ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর বসুন্ধরা গ্রুপের কর্তাব্যক্তিরা বেকায়দায় পড়ে যান। সমিতির কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা অগ্রিম নিয়েছেন, কিন্তু সমিতির জমি ও প্লট বুঝিয়ে দেননি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চুক্তি বাস্তবায়নের চাপে পড়েছেন তারা। এখনো সমিতির জমি বুঝিয়ে দেয়া বাকি আছে ৫৬ বিঘা। এছাড়া সমিতির সঙ্গে ইতিপূর্বে সম্পদিত চুক্তি ও কার্যক্রমে নানা রকমের অসঙ্গতি রয়েছে। আর সেই কারণেই বসুন্ধরা গ্রুপ পরিকল্পিতভাবে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছে। বিসিএস প্রশাসন কল্যাণ সমিতির নেতাদের ইতিপূর্বের বক্তব্য এবং লিখিত এজহারেও এ তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু সমিতির নেতারা সেই অবস্থান থেকে এখন সরে এসেছেন।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর ইস্কাটনের বিয়াম ভবনে বড় আকারের এক বিস্ফোরণ হয়। এতে ভবনের দুজন নিহত হন। তাৎক্ষণিকভাবে এটিকে এসির বিস্ফোরণ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এমনকি পুরো ঘটনাটাই চাপা দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। গণমাধ্যমে যাতে খবরটা ফলাও করে প্রচার করা না হয় এ ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ থেকে। ফায়ার সার্ভিস এবং স্থানীয় থানা-পুলিশকেও ম্যানেজ করা হয়েছিল।

২৭ ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় আড়াইটায় হঠাৎ করেই ভবনটির পঞ্চম তলায় বিস্ফোরণ হয় এবং এ থেকে অগ্নিকাণ্ডও হয়। ভবনের ৫ম তলার ওই ফ্লোরটিতে ছিল বিসিএস প্রশাসন কল্যাণ সমিতির অফিস। বিস্ফোরণ এবং আগুনের লেলিহানে ফ্লোরটির প্রায় সবগুলো কক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরমধ্যে কয়েকটি কক্ষ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। কল্যাণ সমিতি অফিসের কাগজপত্রসহ, দলিলপত্র, ব্যাংকের কাগজপত্র, চুক্তিপত্র, আসবাবপত্র সবই পুড়ে যায়। ভবনের ওই ফ্লোরে থাকা দু’জন কর্মচারীর একজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। অন্য একজন দগ্ধ অবস্থায় পরবর্তীতে হাসাপাতালে মারা যান। রহস্যজনকভাবে শুরু থেকেই ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এতবড় ঘটনাকে ‘এসির বিস্ফোরণ’ এবং একটি সাধারণ ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও এতে নাশকতার যথেষ্ট আলামত এমনকি প্রমাণাদিও ছিল। ভবনের সিসিটিভি ফুটেজেই এর বড় প্রমাণ রয়ে গিয়েছিল। তারপরও এটিকে ‘সাধারণ দুর্ঘটনা’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজে এ ব্যাপারে অনুসন্ধানী একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৭ মার্চ, ২০২৫। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, “বিয়াম ভবনে বিস্ফোরণ পরিকল্পিত নাশকতা, অভিযোগের তীর বসুন্ধরা গ্রুপের দিকে! মাস্ক-গ্লাভস পরা যুবক এখনো গ্রেফতার হয়নি”।

গত ২৮ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান যে তথ্য তুলে ধরেন তাতে বলা হয়, “ঘটনার পেছনে ছিলেন বিয়াম ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম। তিনি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভবনের একটি কক্ষে আগুন ধরিয়ে নথিপত্র পুড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। এ কাজে তিনি ভাড়া করেন তার পূর্ব পরিচিত আশরাফুল ইসলামকে। দুজনের মধ্যে নথিপত্র ধ্বংসে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার মৌখিক চুক্তি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আশরাফুল সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন এবং অফিস সহায়ক আব্দুল মালেক ও গাড়িচালক ফারুক ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুন লাগার পরপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলেই মারা যান অফিস সহায়ক মালেক। আহত গাড়িচালক ফারুককে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেই তিনি মারা যান।”

এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, সমিতির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জাহিদুল ইসলামের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। বিয়াম এবং সমিতি আলাদা প্রতিষ্ঠান। তাহলে কেন তিনি ১০-১২ লাখ টাকা ব্যয় করে নথি পোড়ানোর পরিকল্পনা করলেন, এ প্রশ্নের জবাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পিবিআই কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। অদৃশ্য ইশারায় তাদের তদন্তও আর এগোচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাহিদুল ইসলামকে ভাড়া করেছে অন্য কেউ। এ ব্যাপারে একমাত্র নাম আসছে বসুন্ধরা গ্রুপের। সমবায় সমিতির নেতাদের ইতিপূর্বের বক্তব্যেও তা উঠে এসেছে। এ ঘটনায় ২৮ ফেব্রুয়ারি হাতিরঝিল থানায় জিডি এন্ট্রি করেন বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক, সরকারের সাবেক সচিব মোহাম্মদ মসিউর রহমান। এরপরে ৪ মার্চ তিনি থানায় এজহারও দায়ের করেন। পরিকল্পিত নাশকতার কথা উল্লেখ করে তিনি এজহারে। পরিকল্পিত নাশকতার জন্য তিনি নাম উল্লেখ না করে বসুন্ধরা গ্রুপকেই সরাসরি দায়ী করেন। দায়েরকৃত এজহারে তিনি ‘একটি ডেভেলপার কোম্পানির’ সঙ্গে তাদের সম্পাদিত চুক্তিসমূহ বাস্তবায়ন না হওয়াসহ বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করেছেন। সমিতির সভাপতি, সাবেক সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তারও এ বিষয়ে দেয়া এক লিখিত বিবৃতিতে একই অভিযোগ করেছেন।

কিন্তু এরই মধ্যে সমিতির নেতারা আর সেই অবস্থানে নেই। সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মসিউর রহমানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপকালে জানা যায়, তিনি এখন আর বসুন্ধরা গ্রুপকে দায়ী করতে চান না। তাহলে পরিকল্পিত বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ড কে ঘটিয়েছে, এ প্রশ্নের জবাবও তার কাছে নেই। তিনি বরং বিষয়টি চাপা দিতে চাইছেন বলে কথাবার্তায় ফুটে উঠলো। যদিও এ প্রশ্নের জবাব পাওয়াটা সমিতির জন্য অত্যন্ত জরুরি।

শীর্ষনিউজ