Image description

আগামী বছরের ৫ অথবা ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ধরেই সব প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারিখ স্পষ্ট না করলেও ইসি সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য বিশ্লেষণে এমন তথ্য মিলছে। প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে একই দিনে গণভোট যুক্ত হওয়ায় নতুন রোডম্যাপ করতে হচ্ছে ইসিকে।

গণভোট ও সীমানা জটিলতা না কাটায় প্রভাব ফেলতে পারে তফসিলে। তবে ঘোষিত সম্ভাব্য সময়ে নির্বাচন করতে হলে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা না হলেও প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। কমিশনও সেটা চায়।

ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, আদেশের কপি (সার্টিফায়েড কপি) পেলে করণীয় ঠিক করবে কমিশন। তবে সংসদীয় আসনের জটিলতার মীমাংসায় বিলম্ব হলে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় প্রভাব পড়বে।

ইসি সূত্র জানায়, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে এনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চলতি মাসের মধ্যে প্রাক্–প্রস্তুতি শেষ করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অথবা প্রথমার্ধেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার চিন্তা আছে কমিশনের। নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে পরিবর্তন করতে হবে নির্বাচনি রোডম্যাপ। এছাড়া সীমানা নিয়ে এক ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। ফলে তফসিল ঘোষণার জন্য ডিসেম্বরের ৪ অথবা ৭ তারিখ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এই দুই তারিখে না হলেও ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধেই তফসিল ঘোষণার ছক কষছে কমিশন। তফসিল ঘোষণা করলে ভোটগ্রহণের জন্য ৬০ দিন সময় পাবে কমিশন।

 

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের রমজানের আগে সম্পন্ন করতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিংয়ে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘ভোটগ্রহণের ৬০ দিন আগে আমরা তফসিল ঘোষণা করবো। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে আমাদের বলা হয়েছে আগামী রমজানের আগে ভোটের ব্যবস্থা করতে। ১৭ বা ১৮ ফেব্রুয়ারি রমজান শুরু। কাজেই ওইভাবে নির্বাচনের তারিখ আপনি বের করতে পারেন।’

এর আগে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার গত ৩১ অক্টোবর পটুয়াখালী সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে এবং ভোটগ্রহণ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে।

তফসিল ঘোষণার ৪৫ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণের রেকর্ড আছে। সুতরাং ৬০ দিন আগে তফসিল ঘোষণা যথেষ্ট সময় বলে দাবি নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের। তফসিল ঘোষণা প্রসঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘৬০ দিন হাতে রেখে ভোট করা সম্ভব। তফসিল ঘোষণার ৪৫ দিনে ভোট করার ইতিহাস বাংলাদেশে আছে। প্রেক্ষাপট কিন্তু আলাদা। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে সংসদ ভেঙে দেওয়ার। সুতরাং ৬০ দিন হাতে রেখে ভোট করা মানে হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে তফসিল ঘোষণা করা হচ্ছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।’

ইসি সূত্রে জানা যায়, মোটাদাগে জাতীয় নির্বাচনের বড় প্রস্তুতির মধ্যে আছে—ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দেওয়ার মতো কাজগুলো। এর মধ্যে বেশকিছু প্রস্তুতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে শেষ করতে হয়। এ ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

ভোটার তালিকার কাজ প্রায় শেষ। খসড়া অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১২ কোটি ৭৬ লাখ ১২ হাজার ৩৮৪ জন। আগামী ১৮ নভেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে।

প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের এবার ভোট দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে ইসি। তারা ভোট দেবেন পোস্টাল ব্যালটে। এক্ষেত্রে ভোট দেওয়ার জন্য আগে প্রবাসী ভোটারদের ইসির নির্দিষ্ট অ্যাপে নিবন্ধন করতে হবে। ১৮ নভেম্বর এই অ্যাপ উদ্বোধন করে কমিশন। তবে দুটি বিষয় নিয়ে চিন্তিত ইসি। হঠাৎ করেই গণভোটের সিদ্ধান্ত ও সীমানা জটিলতা। ইতোমধ্যে ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে কয়েকটি আসনের সীমানা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট হয়েছে। কমিশন আশা করছে, চলতি মাসের মধ্যে এসব নিষ্পত্তি হবে।

৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করেছে ইসি। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটার কাজও প্রায় শেষ। নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে এখন প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুতির কাজও চলছে। নির্বাচন কর্মকর্তা চূড়ান্ত করা ও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তফসিল ঘোষণার পর।

নির্বাচনের তফসিলে কী থাকে?

নির্বাচন আয়োজন করার জন্য যেসব কাজকর্ম জড়িত তার সবকিছুর জন্য একটি সময় বেঁধে দেওয়া হয় তফসিলে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘খুব সহজ ভাষায় এটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখের একটি আইনি ঘোষণা।’

প্রার্থীরা তাদের প্রার্থিতার মনোনয়নের কাগজ কত তারিখ জমা দেওয়া শুরু করতে পারবেন, মনোনয়নের কাগজ নির্বাচন কমিশন কতদিনের মধ্যে বাছাই করবে, বাছাই প্রক্রিয়ায় যদি সেটি বাতিল হয়ে যায় তাহলে প্রার্থিতাপ্রত্যাশী ব্যক্তি কতদিন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারবে তার সময় বেঁধে দেয় কমিশন। যারা প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন তাদের তালিকা কবে নাগাদ ছাপানো হবে, নির্বাচনি প্রচারণা কবে থেকে শুরু করা যাবে, কতদিন পর্যন্ত তা চালানো যাবে- সেটির উল্লেখ থাকে তফসিলে।

সাধারণত প্রার্থীর নির্বাচনি প্রতীক ঘোষণার সঙ্গে প্রচারণা শুরুর তারিখ সম্পর্কিত থাকে। নির্বাচন কত তারিখ হবে, কোন সময়ে শুরু হবে আর কোন সময় পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে তার বিস্তারিত এবং ভোটের পর ভোট গণনা কীভাবে এবং কোথায় হবে তারও পরিষ্কার উল্লেখ থাকে। এই পুরো বিষয়টির সমষ্টিকেই নির্বাচনের তফসিল বলা হয়।

তফসিলের সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হয়

কিছু বিষয় সংবিধানে একদম নিশ্চিত করে বলা আছে। তাই সেগুলো নিয়ে আদৌ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ারই দরকার হয় না। যেমন, সংবিধানে বলা আছে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। তবে এবারের ভোটের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে সংসদ ভেঙে দেন। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। সুতরাং, সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনে ভোট করার সেই বাধ্যবাধকতা নেই। তাই ৬০ দিন অথবা দুই মাস হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে কমিশন। কমিশনারদের মধ্যে সেটি নিয়ে এবং নির্বাচনের তফসিলের অন্য সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর বেশিরভাগ কমিশনার যে সিদ্ধান্ত দেয় সেটি গৃহীত হওয়ার কথা।

একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের চ্যালেঞ্জে ইসি

প্রায় ৩৪ বছর পর আরেকটি গণভোট হচ্ছে, যা বাংলাদেশে প্রথম। জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি গণভোটের প্রচারণা, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে ভোটকক্ষ বাড়ানো, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আর ভোটার সংখ্যা অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ সরঞ্জাম বাড়াতে হবে গণভোটে। প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের বিষয়টিও রয়েছে। সংসদ নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে ব্যাপক প্রচার থাকবে প্রার্থীদের। আর গণভোট নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর বিষয় রয়েছে। এছাড়া একই দিনে জাতীয় ও গণভোট হলে ব্যয়ও ২০ শতাংশের বেশি বাড়বে। দেশের প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটারের সঙ্গে প্রবাসের লাখ দশেক ভোটার নিয়ে এ নির্বাচন হবে। ফলে একই দিনে দুটি কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে ইসি।

একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ; তবে অসম্ভব না জানিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ইসির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের। কারণ ইসি জাতীয় ভোট রোডম্যাপ তৈরি করে এগিয়ে গেছে। মাঝখানে গণভোটের সিদ্ধান্ত। এখন রোডম্যাপে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার থেকে প্রয়োজনে লিখিত নির্দেশনা পেলে ইসি কাজ শুরু করবে। হাতে সময় কম কাজটা দ্রুত করতে হবে।’

 

গণভোটে বড় চ্যালেঞ্জ ক্যাম্পেইন দাবি করে ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, ‘গণভোটে বড় চ্যালেঞ্জ প্রচার-প্রচারণা। রাজনৈতিক দলগুলোকে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য ক্যাম্পেইন করতে হবে। এটা চ্যালেঞ্জিং, তারপরও সম্ভব। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলকে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে।’